ধর্ম ডেস্ক:
মহানবী (স.) ছেলেসন্তান বা মেয়েসন্তান সবাইকে ভালবেসেছেন, আদর করেছেন, কোলে তুলে নিয়েছেন। তবে মেয়েশিশুদের লালনপালন, তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে ফজিলত বর্ণনা করেছেন, তা কিছুটা ভিন্ন। মেয়েসন্তানের লালন-পালন ও ভরণপোষণের জন্যে তিনি কোথাও জান্নাতের ওয়াদা করেছেন, কোথাও জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন।
এক হাদিসে এসেছে— ‘যার তিন জন কন্যা সন্তান হবে আর সে তাদের আবাসের ব্যবস্থা করবে, মমতা প্রদর্শন করবে এবং তাদের ভার বহন করবে, তার জন্য জান্নাত নিশ্চিত। জিজ্ঞেস করা হলো-ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদি দুইজন হয়? বললেন, দুইজন হলেও। বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণের কারো কারো ধারণা হলো- ‘যদি কেউ বলত একজন হলে? তাহলে নবীজি বলতেন, একজন হলেও।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৪২৪৭; মুসতাদরাকে হাকেম: ৭৩৪৬)
অন্য হাদিসে নবীজি (স.) বলেছেন— ‘তোমাদের কারো যদি তিন মেয়ে কিংবা তিন বোন থাকে আর সে তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে, তাহলে সে জান্নাতে যাবে।’ (জামে তিরমিজি: ১৯১২) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যার তিনটি মেয়ে কিংবা তিনজন বোন অথবা দুইটি মেয়ে বা দুইজন বোন রয়েছে আর তাদের সঙ্গে সে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করেছে তাহলে তার জন্যে রয়েছে জান্নাত। (জামে তিরমিজি: ১৯১৬)
উল্লেখিত হাদিসগুলোতে দেখা যাচ্ছে, নবীজি কন্যাসন্তান বা বোনদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও লালন-পালনের প্রতিদান হিসেবে জান্নাত লাভের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা জানি, জান্নাত লাভ করা মানে সাধারণত জাহান্নাম থেকেও দূরে থাকা। কিন্তু এর অর্থ এমনও তো হতে পারে যে, জাহান্নামে গিয়ে পরে জান্নাতে যাওয়া। সেজন্য নবীজি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে বলেও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। হাদিসের ভাষায়, ‘মেয়েদের লালনপালনের দায়িত্ব যার কাঁধে অর্পিত হয় আর তাদের বিষয়ে সে ধৈর্যধারণ করে, তার জন্যে জাহান্নামের আগুন থেকে তারা আড়াল হয়ে থাকবে। (জামে তিরমিজি: ১৯১৩)
সুবহানাল্লাহ! মেয়েশিশুকে যত্নসহ লালনপালনের পুরস্কার কত বড় একটু চিন্তা করুন। একজন পরকাল-বিশ্বাসীর জন্যে এর চেয়ে বড় কোনো পুরস্কারের দরকার হয় না। কিন্তু এর চেয়েও বড় এক পুরস্কার রয়েছে। সেটি হলো নবীজির সঙ্গী হওয়া। মেয়েশিশুদের পরম যত্ন নিলে তারা নবীজির সঙ্গেই জান্নাতে প্রবেশ করবেন। হাদিসের ভাষায়, ‘যে দুটি মেয়েশিশুকে দেখাশোনা করল, লালনপালন করল, আমি এবং সে এভাবে জান্নাতে প্রবেশ করব—এ কথা বলে তিনি হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়েছেন। (জামে তিরমিজি: ১৯১৪)
অতএব, কন্যাসন্তানের সুন্দর লালন-পালন মানে বাবা-মায়ের জান্নাত লাভের মাধ্যম, জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাধ্যম এবং প্রিয়নবী (স.)-এর সঙ্গ লাভের মাধ্যম। তাই কন্যাসন্তানকে বলা হয় পরকালীন মুক্তির পয়গাম।
নবীজি (স.) যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কন্যাসন্তান প্রতিপালনে এ ফজিলতের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন বাবারা মেয়েশিশুকে নিজের জন্যে খুবই অপমানের বিষয় মনে করত। একটা সময় এসে তারা নিজহাতে নিজের মেয়েদের জীবন্ত দাফন করতে শুরু করল। পবিত্র কোরআনেরই একটি বর্ণনা—‘যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মনঃকষ্টে তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে তার কারণে তারা নিজ সম্প্রদায়ের লোক থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে এই সন্তান রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট।’ (সুরা নাহল: ৫৮-৫৯)
সেকালের এক পাষণ্ডতার উদাহরণ
এক সাহাবি ইসলাম গ্রহণ করার পর নবীজি (স.)-এর কাছে এসে নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন। তার ভাষ্য- আমার যখনই কোনো মেয়েশিশু জন্ম নিত আমি তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতাম। একবার আমি সফরে ছিলাম। তখন আমার এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার মা তাকে বাড়িতে না রেখে তার মামাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমি যখন সফর থেকে ফিরে আসি তখন সন্তানের খবর নিই। সে আমাকে বলল-আমাদের এক মৃত শিশু জন্ম নেয়। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। আমার মেয়েটি তার মামার বাড়িতেই বড় হতে থাকে। একদিন সে তার মাকে দেখতে আসে। তার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হই। পরে আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি-সে আমারই মেয়ে। এরপর আমি তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তার জন্যে মাটিতে একটি গর্ত খুঁড়ি। তাকে সেখানে ফেলে দিই। সে আমার কাছে জানতে চায়-বাবা, তুমি আমাকে কী করবে? আমি তার উপর মাটি ফেলতে থাকি আর সে বলতে থাকে-বাবা, তুমি কি আমাকে মাটিচাপা দিচ্ছ? আমাকে একাকী ছেড়ে দাও, আমি অন্য কোথাও চলে যাই। কিন্তু তার কোনো কথা না শুনে আমি তার উপর মাটি ফেলতেই থাকি, একপর্যায়ে তার সব আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যায়। এ বিবরণ শুনে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছিলেন, এ তো নির্ঘাত এক পাষণ্ডতা! যে দয়া করে না, তাকেও দয়া করা হবে না! (আলওয়াফী বিল ওয়াফায়াত, কায়েস ইবনে আসেম এর জীবনী দ্রষ্টব্য)
এই পরিস্থিতি যখন সমাজে বিরাজ করছিল, তখন রাসুলুল্লাহ (স.) মেয়েশিশুদের ভরণ-পোষণের এমন অতুলনীয় ফজিলতের কথা ঘোষণা করেছেন। এর পাশাপাশি সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, নারীদের বিভিন্ন অধিকারের কথা। মনে রাখতে হবে, ছেলে বা মেয়ে দান করেন মহান আল্লাহ। এটি সম্পূর্ণই তাঁরই ইচ্ছাধীন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন এভাবে— ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা তিনি কন্যাসন্তান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা দান করেন পুত্রসন্তান। অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তিনি বন্ধ্যা করে রাখেন। তিনি সর্বজ্ঞ, শক্তিমান। (সুরা শূরা: ৪৯-৫০)
একজন আল্লাহ-বিশ্বাসী মুমিন হিসেবে চিন্তা-চেতনায় এবং কাজে-কর্মে এ বাণীর প্রতি পূর্ণ আস্থা আমাদের রাখতে হবে। সুন্দরভাবে লালন পালন ও আদর যত্নের দিক থেকে ছেলেশিশুকে অগ্রাধিকার যাবে না, মেয়েশিশুকেও সমানভাবে যথাযথ অধিকার দিয়ে লালন পালন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মেয়েশিশুর প্রতি যত্নশীল ও সুন্দর আচরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply