২০১৬ সালের মে মাস! খারুভাজ, ভেলামারী নদীগর্ভে বিলীন, এইবার আমাদের গ্রামের পালা। নদী ভাঙ্গনে একের পর এক পরিচিত মানুষের বাড়ি বিলিন হচ্ছে, জন্মের পর থেকে যাদের মুখ দেখে বড় হয়ে ওঠা, আমাদের তরুণদের পড়াশোনা ও মার্জিত জীবন গঠনের অন্যতম পরামর্শক ও উৎসাহ প্রদানকারী মুরুব্বিদের বিদায়ের মুহূর্তগুলো মনে হলে এখনো অন্তর কেঁপে উঠে। বসতবাড়ি, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, অসংখ্য স্কুল, মসজিদ মাদ্রাসা নদী গর্ভে বিলীন হতে দেখেছি নিজের চোখে। ১ বছরের ব্যবধানে আমাদের বাড়িই দুইবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী ভাঙ্গন রোধে নূন্যতম ব্যবস্থা তো দূরে থাক, ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ গুলোকে শান্তনা দেওয়ার জন্য হলেও কোনো জননেতা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কাউকেই দেখিনি সেই দুঃখের দিনগুলোতে।
এ তো কেবল একটা উদাহরণ মাত্র। রাজিবপুর সদর ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের অধিকাংশ জায়গায়ই নদী ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। সেই হিসাবে আমাদের এলাকায় নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা কিন্তু কাজের বেলায় আমরা সতীনের তৃতীয় সন্তানের চেয়েও অবহেলিত।
রাজিবপুর সদর থেকে আমাদের বিচ্ছেদের কারন নদী। উত্তর কোদালকাটি যারা বসবাস করেন তাদের তিনটি, কোদালকাটির মধ্যভাগে যাদের বসবাস তাদের দুইটি এবং পূর্বে যারা বসবাস করেন তাদের একটি নদী পার হয়ে রাজিবপুর যেতে হয়। খাজার খেওয়াঘাটে কাঠের ব্রিজ হওয়ায় (যা সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট বিপ্লব হাসান পলাশ করে দিয়েছেন) কোদালকাটির পূর্বাঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের যোগাযোগে ভোগান্তি কমেছে, কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা না হওয়ায় এটাও তেমন কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে না। আগামী বর্ষার মৌসুম থেকেই আবার নৌকা পার হয়েই রাজিবপুর আসতে হবে। যারা উত্তর কোদালকাটি কিংবা কোদালকাটি তে বসবাস করেন তাদের বন্যার সময় নৌকা মিস হলে সারাদিন এমনিতেই ব্যয় হয়ে যায়। আর সেটা যদি হয় রাতের ৯ টার পর তাহলে তো রাজিবপুরে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই! দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কিংবা গভীর রাতে যত ইমারজেন্সী কাজই হোক আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে নদী পারাপারের জন্য।
দিনের বেলাটা যাই হোক, উন্নয়ন বঞ্চিত উত্তর কোদালকাটির এলাকার প্রতিটা ঘরের প্রতিটা রাত কাটে ভয় আর শঙ্কায়। এই বুঝি প্রিয়জন কেউ অসুস্থ্য হয়ে গেলো। আমি কান পাতলে স্পষ্ট শুনতে পাই, প্রতিটা ঘর থেকে আওয়াজ আসছে মূমুর্ষ রোগে আক্রান্ত কোন শিশুর পিতা-মাতার আহাজারীর শব্দ, প্রসূতি সেবা পাওয়ার জন্য কোন বোন-মায়ের আকুল আবেদন, মৃত্যু পথযাত্রী কোন বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সন্তানের নিস্ফল ছুটাছুটি এবং মিথ্যা আশায় আশ্বস্ত করার পরিচিত সেই চিরচেনা বাণী- “রাত পোহাইতে বেশি দেরী নাই! একটু ধৈর্য্য ধরো মা, একটু ধৈর্য্য ধরো বাবা, সকালেই নৌকা ব্যবস্থা করে তোমারে হাসপাতালে নিয়া যামু।” কতো পরিবারের যে আর রাত পোহায় না! কতো প্রাণে যে আর কখনোই সকাল আসে না! কতো নিথর দেহ যে শেষবেলায় সকালের নৌকায় উঠে!
এতো গেলো বর্ষাকালের কথা শুষ্ক মৌসুমে রাজিবপুরে আপনাকে/আমাকে পৌঁছাতে হলে পারি দিতে হবে তপ্ত বালুর সীমাহীন দূর্যোগময় পথের সন্ধিক্ষণ। রাস্তাঘাটের যে বেহাল দশা, একবার অপরিচিত কেউ এসব পথ দিয়ে যাতায়াত করলে দ্বিতীয়বার ঐপথে পা বাড়াবার সাহস করবে না। অথচ উন্নয়ন বঞ্চিত, অবহেলিত কোদালকাটি’র সু্বিশাল জনগোষ্ঠি যুগের পর যুগ ব্যবহারের অনুপযোগী রাস্তাঘাট ব্যবহার করেই দিনাতিপাত করে যাচ্ছে। গত ১০-১৫ বছরে আমাদের স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা, জননেতারা আমাদের কষ্ট লাঘবে কি করেছে, ভাবলেই মনে অসংখ্য প্রশ্ন জাগে কিন্তু শব্দ হয়ে ধরা দেয় না। শুধু উপলব্ধি করি, এসব জনপদে জন্মগ্রহণ ও বসতি স্থাপনই কি আমাদের আজন্ম পাপ?
চিকিৎসা হোক, শিক্ষা হোক, ব্যবসা হোক, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত কৃষিজ পণ্যের বাজারজাত করণ হোক, বিদেশ ফেরত কোন প্রবাসী হোক, দূর জেলায় চাকুরী বা ব্যবসা জনিত কারনে নিজ এলাকায় আগুন্তক কোন ব্যক্তিবিশেষ হোক কিংবা শেষ নিঃশ্বাস ফেলা কোন লাশ হোক, কোদালকাটিতে বসবাস করা এমন কোন বাড়ি বা ব্যাক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদেরকে নৌকা পারাপার ও তপ্ত বালুর সীমাহীন দূর্যোগময় রাস্তার জন্য ভয়ঙ্কর ও বর্ণনাতীত এসব দূর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়নি!
যদি সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে নিশ্চন্তকরণে, ১৫-২০ বছর থেকে যারা আমাদের সংসদীয় আসন, উপজেলা ও ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের কাছে কাছে আমরা প্রশ্ন উৎথাপন করি আমাদের দোষ কোথায়? আমাদের অপরাধ কোথায়? কেনো আমাদেরকে আমাদের মৌলিক অধিকার থেকে, আধুনিকায়ন হওয়া থেকে, অবকাঠামোগতো উন্নয়ন থেকে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্পর্শ থেকে বছরের পর বছর পিছিয়ে রাখা হয়েছে? অত্যন্ত সু-কৌশলে শাসক শ্রেণী আমাদের বিগত দিনগুলোতে মানবাধিকার লঙ্গন করে গেছেন নানা ছলছাতুড়ে, নানান আশার কথা ফাঁকা বুলি দিয়ে।
যদি বলি আমাদের অপরাধ কি? উক্ত এলাকায় জন্মগ্রহণ করা কি আমাদের অপরাধ? রাষ্ট্রকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সবধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা কি আমাদের কোদালকাটির চরের সহজ সরল মানুষগুলোর বিরাট অপরাধ? পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে কুড়িগ্রাম তথা বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার জন্য আমাদের এলাকার আপামর জনগণের যুদ্ধে অংশগ্রহণ, নিজ দেশের কথা ভেবে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর বন্দুকের নলের সামনে শংকর মাধবপুরে ৬৮ জন পূর্বপুরুষদের জীবন বিলিয়ে দেওয়া অপরাধ ছিলো? নাকি ক্ষেত-খামারে কাজ করে তাচ্ছিল্যেের এবং অনেকের গালি হিসাবে শাসক শ্রেণীর ‘চরুয়া’ উপাধি পাওয়া আমাদেে অপরাধ?
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমাদের এলাকায় চোখে পরার মতো কোন উন্নয়ন নাই, সামাজিক নিরাপত্তা ও সংস্কৃতি লালন-পালনের কোন অবকাঠামো নাই, ভালো কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নাই। কিন্তু কেনো?
এলাকার মানুষ যুগের পর যুগ মানুষের প্রাত্যহিক অবর্ণনীয় কষ্ট লাগবের সদরের সাথে কোদালকাটি ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলের (দক্ষিন চর মানুষের সাজাই-পাখিউড়া-মদনের চর) কমিউনিকেশনের জন্য সোনাভরী নদীর উপর খাজার খেওয়াঘাট নামক স্থানে একটি ব্রীজের দাবী করে আসছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমরা যে কাজির গোয়ালঘরের গরুর হিসাবের মতো। ভোটের সময়, উন্নয়নের কৌশল হিসাবে কথার ফাঁকা বুলিতে আছি, কাজে নাই।
আমাদের নির্বাচনী আসনের সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের জননেতারাই এই খাজার ঘাটের ব্রীজ নিয়ে আমাদের সাথে ছলচাতুরি করে এসেছেন। আমাদের রাজিবপুরে ভোট আসে, আমরা কোদালকাটির মানুষেরা নেতাদের মিষ্টি কথায় ভূলে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করি, দিনের পর দিন এইভাবেই ক্ষমতার বদল আসে, কিন্তু আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন বদল নেই।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত প্রতিষ্ঠান স্থাপনে পৃথীবীর রোল মডেল, সেখানে আমাদেরকে কোন তিমিরে ফেলে রাখা হয়েছে, কেনো ফেলে রাখা হয়েছে, কাদের কারনে ফেলে রাখা হয়েছে, জানতে বড় ইচ্ছে করে!
নদী ভাঙন সহ উপরোক্ত প্রত্যেকটি দুর্ভোগ কেবল আমাদের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে না, বরং এটি আমাদের অস্তিত্বের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী ভাঙ্গনে প্রতিদিন আমরা আমাদের প্রিয়জনদের, আমাদের বসতবাড়ি এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে নদীর গর্ভে বিলীন হতে দেখছি। এই বিপন্নতার মুহূর্তে আমাদের তীব্র সংকটকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ না করা হলে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো হারিয়ে যাবে। আমাদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা করা হোক, যাতে আমাদের অঞ্চলের মানুষগুলো জীবনের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা ফিরে পায়। আমরা চাই, আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য এই মুহূর্তে আমাদের কষ্টের কথা শোনার জন্য কেউ এগিয়ে আসুক।
লেখা: ফরিদুল ইসলাম, তরুণ লেখক
Leave a Reply