আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
আরবের যাযাবর জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেদুঈন জাতি অন্যতম। এরা মূলত আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন মরু এলাকায় বসবাসকারী একটি যাযাবর জাতি যারা সৌদি আরব, ইয়েমেন, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে বসবাস করে। কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে না বিধায় এদের যাযাবর জাতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
আরবি ‘বেদু’ শব্দ থেকে বেদুঈন নামটি এসেছে যার অর্থ মরুভূমির মানুষ। তারা নিজেদের প্রকৃত আরব হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। বেদুঈনরা স্বাধীন, কষ্টসহিষ্ণু, এবং প্রতিশোধপরায়ণ জাতি। মূলত উট, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি পশুপালনের মাধ্যমে এই সম্প্রদায়টি জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাই যেখানে পশুখাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, সেখানে গিয়েই বেদুঈনরা বসতি স্থাপন করে।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বেদুঈনরা ছিল প্যাগান বা প্রকৃতি পূজারি। এসময় তারা প্রাচীন ধর্মানুসারে মূর্তিপূজাও করতো। তবে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ইসলাম প্রচার শুরু করার পর বেদুঈনদের অনেক গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আর সেসময় থেকেই তারা মুসলিম হিসেবে পরিচিত। তবে মিশরের সিনাই ও লিবিয়াতে বসবাসকারী কিছু বেদুঈন গোত্রের মাঝে সুফি মতবাদ দেখা যায়।
বেদুঈনদের জীবনযাপন মূলত পশুপালনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। তারা পশুর মাংস খাবার হিসেবে এবং তাদের চামড়া বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরিতে ব্যবহার করে। আগে বেদুঈনরা বণিকদের মরুভূমির মধ্যে পথ চিনিয়ে দিয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তা করতো।
বেদুঈনদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তারা খুবই প্রতিশোধপরায়ণ। আগে জলাধার দখল কিংবা পশুচারণ ভূমি নিয়েও বেদুঈনদের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেত। এছাড়া বেদুঈনদের মধ্যে যদি কাউকে খুন করা হয় তাহলে তাদের প্রধান কাজ হলো ঐ পরিবারের পাঁচজন ভাই কিংবা চাচাত ভাই মিলে খুনীকে খুঁজে বের করে হত্যা করা। যদি খুনীকে খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে সেই খুনীর পরিবারের অন্য একজন পুরুষ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
এছাড়া একসময় বেদুঈনরা হজ্জ্ব কাফেলাদেরও আক্রমণ করতো। যেমন- ১৭৫৭ সালে বনি সাকর নামক বেদুঈন গোত্রের কা’দান আল ফাইয়াজের নেতৃত্বে একটি দল একটি হজ্জ্ব কাফেলাকে আক্রমণ করলে প্রায় বিশ হাজার হজ্জ্ব যাত্রী মারা যায়।
বেদুঈনরা শত শত বছর ধরে মরুভূমিতে বসবাস করে বিধায় মরুর বুকে প্রতিটি জিনিসই তাদের খুব চেনা। আর সেজন্যই ইসরাইলের সেনাবাহিনীতে বেদুঈন ট্র্যাকিং ইউনিট নামক একটি শাখায় মুসলিম বেদুঈনরা দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলিদের প্রতিরক্ষা সেবা দিয়ে আসছে।
আরব বেদুঈনদের খাদ্য তালিকা খুবই সাদামাটা ধরনের। তাদের প্রধান খাবার হলো রুটি, দুধ, দই এবং পশুর মাংস। তবে উৎসবের সময়গুলোতে তারা ভাতও খেয়ে থাকে। এছাড়া ছাগলের মাংস ও চাল একসাথে রান্না করে খেতে তারা পছন্দ করে। তবে তাদের খাদ্য তালিকায় প্রায় সারা বছরই খেজুর থাকে।
পাশাপাশি কফি পান করতে পছন্দ করে বেদুঈনরা। কফি বীজের পাশাপাশি এলাচ ও আদার শেকড় দিয়ে তৈরি এই বিশেষ ধরনের পানীয়টি আরব বেদুঈনদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। তারা অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সাধারণত এই ধরনের কফি এবং খেজুর পরিবেশন করে থাকে।
বেদুঈনদের প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ.ক.ম. আবদুল কাদের বলেন, “বেদুঈনরা খুবই সংগঠিত একটি জাতি যারা ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বদলে পারিবারিক শিক্ষায় দীক্ষিত। তবে বর্তমানে বেদুঈনদের অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের জন্য লোকালয়ে গিয়ে বসবাস শুরু করেছে।”
“সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে এখন বেদুঈনদের জীবনধারাতেও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে তাদের এলাকাগুলোতে টিউবওয়েল এবং বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছেছে। এছাড়া বেদুঈনদের বসবাসরত অঞ্চলগুলোতে স্যাটেলাইট ক্যামেরা থাকার সুবাদে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও এখন আগের চেয়ে বেশ উন্নত। তাই এখন বেদুঈনদের মধ্যে যাযাবর প্রথার পরিবর্তে এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রচলন শুরু হয়েছে”, যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে উন্নত জীবনযাপনের আশায় অনেক বেদুঈন এখন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ছেড়ে লোকালয়ে পাড়ি জমাচ্ছে। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে বেদুঈন জনগোষ্ঠী সর্বদাই অংশ হয়ে থাকবে আরবের বুকে এক অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে।
খবর -আল জাজিরা
Leave a Reply