আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভাগ্যবান দুর্ভাগা’ শব্দদুটি একসাথে দেখতেই খুব অদ্ভুত লাগছে, তাই না? নিশ্চই ভাবছেন যে একই ব্যক্তি কীভাবে একইসাথে ভাগ্যবান ও দুর্ভাগা হয়? তবে ফ্র্যান সেলেকের জীবন নিয়ে জানলে তাই-ই মনে হবে, ভাগ্য যার সাথে খেলেছে নিষ্ঠুর এক খেলা।
বারবার তাকে মৃত্যুর পথে নিয়ে গিয়েছে ভাগ্য, কিন্তু ঠিকই ফিরিয়ে এনেছে আবার, যখন অন্যদের প্রতি সহায় হয়নি। জীবন যে নাটকের চেয়েও নাটকীয়, তা হয়ত তার জীবন দেখলেই বোঝা যায়।
নম্রভদ্র চুপচাপ এই মানুষটি ১৯২৯ সালে ক্রোয়েশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন সঙ্গীত শিক্ষক হিসাবে তুলনামূলক খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছিলেন, মোটেও কোনো দুঃসাহসিক জীবন ছিল না তার। তবে এই সবই পরিবর্তন হয়ে যায় ১৯৬২ সালে একটি অবিশ্বাস্য ট্রেন যাত্রার পর। তারপর থেকেই তার বিচিত্র দুঃসাহসিক জীবনের শুরু হয়।
বসনিয়ার রাজধানী সারাজেভো থেকে ক্রোয়েশিয়ার শহর ডুব্রোভনিকের রেলপথে যাওয়ার সময়, এক দুর্ঘটনায় তার ট্রেনটি নদীতে পরে যায়। তার বগির সতেরো জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিল এই দুর্ঘটনায় কিন্তু সেলেক শুধুমাত্র একটি ভাঙা হাত এবং হাইপোথার্মিয়া নিয়েই বেঁচে যান।
তিনি সাঁতার কেটে তীরে যেতে সক্ষম হন এবং তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেললে উদ্ধারকর্মীরা তাকে খুঁজে পান। এই যন্ত্রণাদায়ক ঘটনাটি তার অদ্ভুত জীবনের শুধুমাত্র সূচনা।
পরের বছর সেলেক ক্রোয়েশিয়ার শহর জাগরেব থেকে রিজেকা যাচ্ছিলেন বিমানপথে। মাঝপথে একটি দুর্ঘটনায় বিমান থেকে দরজা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এই সময় উনিশ জন প্রাণ হারিয়েছেন কিন্তু সেলেক ভাগ্যের জেরে আকাশ হতে একটি খামারের বিশালাকৃতির খড়ের গাদার উপর পরেন। পরবর্তীতে তিনি একটি হাসপাতালে জেগে উঠলেন, প্রচন্ড ভয় পেলেও শারীরিকভাবে পুরোপুরিই অক্ষত ছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে, হতভাগা সেলেক আরেকটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। তিনি যে বাসে করে তার গন্তব্যে যাচ্ছিলেন তা আবার নদীতে পরে যায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। এবারও সেখানে চারজন হতাহতের ঘটনা ঘটলেও তিনি আবারও অক্ষত অবস্থায় বেঁচে ফিরেন।
পরবর্তী কয়েক বছর সেলেকের জীবনে অস্বাভাবিক আর কিছু ঘটেনি।
কিন্তু ১৯৭০ সালে তার গাড়িতে জ্বালানি ভরার সময় গাড়ির ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়। সেলেক একটুর জন্য বেঁচে যায় সেবার। ১৯৭৩ সালে সেলেক আরেকটি অদ্ভুত গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন, যখন একটি ত্রুটিপূর্ণ জ্বালানী পাম্পের জন্য তার গাড়ির ভিতর পেট্রোল লিক হয় এবং গাড়ির ভিতর আগুন ধরে যায় এবং সেলেকের মাথার সব চুল ও ভ্রু পুড়ে গেলেও তিনি অক্ষত থাকেন।
১৯৯৫ সালে জাগরেব শহরে একটি বাসের সাথে মাঝরাস্তায় ধাক্কা খেয়ে পরার পর সাথে সাথে তিনি আবার ক্রোয়েশিয়ার খবরে আসেন। পরের বছর তার জীবনের সপ্তম এবং চূড়ান্ত বিখ্যাত বিপর্যয় এসেছিল: জাতিসংঘের একটি ট্রাক তার গাড়ির দিক বরাবর পাহাড়ি ঢাল বেয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসে এবং তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়।
সেলেক দ্রুতগতিতে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে পারলেও ট্রাকটি চালকসহ খাদে পরে গিয়ে সেলেকের চোখের সামনে বিষ্ফোরিত হয়। ২০০২ সালে তার ৭৩ তম জন্মদিনের মাত্র দুদিন পরে তিনি লটারিতে ৬ লাখ ইউরো জিতেন! প্রথমে তিনি দুটি বিলাসবহুল বাড়ি ও ইয়ট কিনলেও পরবর্তীতে ২০১০ এ তিনি তার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সকল অর্থ বিলিয়ে দিয়ে তার পঞ্চম স্ত্রীর সাথে মিতব্যয়ী জীবনযাপন শুরু করেন।
সেলেকের জীবনের নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতাগুলো কোনোদিন অন্য কাউকে দিয়ে যাচাই করা হয়নি এবং মাঝেমধ্যে তার নিজের মুখ থেকে বলা ঘটনাগুলোতেই কিছুটা অসামঞ্জস্যতা দেখা যেত। তাই সেলেকের জীবন নিয়ে অনেকের মধ্যেই কিছুটা সন্দেহ রয়েছে।
তবে সন্দেহ থাকুক আর নাই থাকুক, সেলেক যে এক অভিনব জীবন কাটিয়েছেন এবং তার দেশ একজন রূপকথার কিংবদন্তী হয়ে গেছেন, তা কখনো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ২০১৬ সালে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন অতিমানব খ্যাতি পাওয়া এই সৌভাগ্যবান দুর্ভাগা ব্যক্তি।
খবর-সিএনএন
Leave a Reply