রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর পূর্ব বিলপাড়া—যে অঞ্চল এক সময় ছিল শস্যশ্যামল, আজ সে স্থানে নেমে এসেছে নির্মম নীরবতা। প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদ, যা ছিল জীবনের উৎস, আজ তা রূপ ধারণ করেছেন বিপন্নতার। তার হিংস্র স্রোত যেন দুঃখের করুণ সুরে গায়ে ঘেঁষে আসছে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে দিচ্ছে কৃষকের স্বপ্নের আকাশ।
শুকনো মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে চাষী আজহারুল ইসলাম, যার হৃদয়ে জমা ছিল হাজারো আশা। আধা পাকা ধানের খেত ও বাদামের ক্ষেত যেন ছিল তাঁর জীবনের প্রাপ্তির প্রতীক। আজ সে চেয়ে দেখছে, নদীর প্রবাহে তাঁর শ্রমের ফল স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। ‘আমার স্বপ্ন, আমার জমি, আমার ধান, সবই আজ নদীর সাথে মিলিত। আমি কি পাব? এই অঞ্চল, প্রজন্মের স্বপ্ন সন্তানদের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারে,’—বলতে বলতে তাঁর চোখের কোণে জল চলে আসে।
গ্রামের এক বৃদ্ধ কৃষক, যিনি নদীটির সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, আজ তিনি নির্বাক। ‘এখন আমি কীভাবে বাঁচব? আমার জমি, আমার পরিচয়—সব কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। গত রাতে আমি গভীর চিন্তায় ছিলাম,পূর্বেও পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়েছি, অসংখ্য জমিজামা নদীগর্ভে গ্রাস করেছে আগেই এই টুকুই সম্ভল ছিলো এখন সেটুকুও ভেঙে যাচ্ছে’—তাঁর কণ্ঠে যে দুঃখ লুকিয়ে আছে, তা যেন একটি নিঃশ্বাসে প্রমাণ করে।
বৃদ্ধ ব্যক্তিটির কষ্টের কাহিনীতে যেন প্রতিধ্বনিত হয় এক প্রাচীন সত্য—মানবের আশা নদীর মাঝে পলির মতো ছড়িয়ে পড়ে। নদীর স্রোতের সাথে সাথে এখানকার মানুষের আত্মবিশ্বাসও ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে। এলাকার তরুনদের মুখে হাসির রং আজ কালো। নদী যেন তাদের সমস্ত প্রাপ্তিকে গ্রাস করছে।
এভাবে, শংকর মাধবপুর পূর্ব বিলপাড়ার কৃষকরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। তাদের জমি হারানো, তাদের জীবনযাত্রা ভেঙে পড়া, সব কিছুই যেন এক প্রবল সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু তাদের শস্যই ও জমিই হারাচ্ছে না, বরং তারা হারাচ্ছে তাদের আত্মা, তাদের ঐতিহ্য, এবং তাদের পরিচয়।
ব্রহ্মপুত্রের এই নির্মমতায় যখন তাদের অস্তিত্ব ঝুঁকির সম্মুখীন, তখন এই প্রশ্ন জাগে—প্রকৃতির বিরূপতার সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করবে এই দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকরা? তাদের কষ্টের কাহিনী কি একদিন মানবতার হৃদয়ে দাগ কাটবে? সময়ই হয়তো এর উত্তর দেবে, কিন্তু এই নদীর দারুণ রূপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকদের হতাশা যেন চিরন্তন একটি আখ্যানের অংশ হয়ে গেছে।
বিবর্তনের এই গতি কি আমাদের সভ্যতাকে আরো নীচে নিয়ে যাবে, নাকি নতুন একটি দিগন্তের সন্ধান দেবে? ব্রহ্মপুত্রের এই বিভীষিকায় কৃষকদের হৃদয়ে কি কখনো আবার আশা জাগ্রত হবে? তাঁদের কষ্টের মাঝে নিহিত রয়েছে এক গভীর মানবিক সংকট, যা মানবতার জন্য একটি চিরকালীন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকবে।
Leave a Reply