ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষক এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান৷ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চের (নিটার) নারী সহকর্মীদের হেনস্তা ও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে৷
২০২১ সালের ২২ নভেম্বর তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের কাছে এই অধ্যাপকের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে নিটারের ৩৭ জন শিক্ষক লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন৷ এর মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে দুজন লিখিতভাবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন৷ এতে মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদে নিয়োগের আদেশের পর সমালোচনা তৈরি হলে সেই নিয়োগ আদেশ স্থগিতও করা হয়েছিল৷
অন্যদিকে অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিল না৷ তাছাড়া বিভাগের একাধিক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে৷ এই দুই কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাঁর সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছে৷
নীল দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কালাম আজাদ৷ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিভাগের নারী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে তাঁর দ্বারা যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছেন৷ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে এই অধ্যাপকের আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থানসহ নানা অভিযোগে আগে থেকেই তাঁর ওপর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছিল৷ এ কারণে তাঁর ক্লাস বর্জন করেছে মার্কেটিং বিভাগের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা৷
গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরেছিল৷২২ তারিখ থেকে অক্টোবরের ৭ তারিখ পর্যন্ত ক্লাস হলেও অনেক বিভাগেই শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত কিছু শিক্ষকের ক্লাসে অংশ নেয় নি। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বিরোধিতা এবং আগে থেকেই নানা অভিযোগ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও অনুষদের অন্তত ৫০ জন শিক্ষকের ক্লাস বর্জন করেছে শিক্ষার্থীরা৷ ওই শিক্ষকেরা নিজেরাও ক্লাস নিতে বিভাগে আসছেন না৷ বেশির ভাগ বিভাগ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছে৷ কিন্তু কিছু বিভাগে এখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি৷ শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা ওই শিক্ষকদের ক্লাসে যাবেন না৷
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই শিক্ষকদের অধিকাংশই নীল দলের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে একাধিক শিক্ষক আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেননি৷ কারও কারও সে সময়ের বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা তাঁদের বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দুই প্রভাষক মো. আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া ও প্রভাষক মিজ শাহরিমা তানজিনা অর্ণিকে আন্দোলনের সময়েই বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা৷
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অন্তত ১৩ জন শিক্ষকের ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছে অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা৷ তাঁদের মধ্যে মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান ও মো. আবুল কালাম আজাদ রয়েছেন৷ বর্জনের তালিকায় আছেন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক সুমন দাস, শবনম জাহান ও মো. মোশাররফ হোসেন, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেদ বিন আমির, টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মো. আফজাল হোসেন ও সামশাদ নওরীন, ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শেখ তানজিলা দীপ্তি, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা আক্তার, অধ্যাপক মো. মুশফিকুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও মো. জামিল শরীফ৷
শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষকদের চলমান ব্যাচগুলোর ক্লাসে ও কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে না দেওয়ার বিষয়ে অনড়৷ এ বিষয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছি৷ শিক্ষার্থীরা এখন সন্তুষ্ট এবং তারা নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিচ্ছে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা ও মো. মনিরুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান ও জিনাত হুদা, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাবের আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক শাহরিয়ার ও মারিয়া হোসাইন, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের মুহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মিজ সুমাইয়া ইকবাল ও এ বি এম নাজমুস সাকিব, লোকপ্রশাসন বিভাগের সাদিক হাসান এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকীর ক্লাস বর্জন করেছে শিক্ষার্থীরা৷
কলা অনুষদের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বায়তুল্লাহ কাদেরী, তার বিরুদ্ধে এখনো আন্দোলন চলমান, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী ফারজানা আফরীন, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম,সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম সানা ও মোহাম্মদ ইমাউল হক সরকার, উর্দু বিভাগের ১ জন অধ্যাপক মো. মাহমুদুল ইসলাম, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজের প্রভাষক মো. রাকিবুল হাসান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২ জন অধ্যাপক আবদুল বাছির ও অধ্যাপক মো. আবদুর রহিমের ক্লাসও শিক্ষার্থীরা বর্জন করেছেন৷
Leave a Reply