কিছু জীবনগাথা নিস্তব্ধতার মাঝেও এক গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে। মোঃ মাসুদ রানা, শংকর মাধবপুরের সেই প্রতিভাবান তরুণ, যার ফুটবল দক্ষতা একদিন কুয়াশার ভেতর থেকে উদ্ভাসিত সূর্যের মতো ছিল, আজ নিজেই এক দুঃস্বপ্নের বন্দি। মাঠের মধ্যে যিনি ছিলেন দুর্বার, আজ তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ব্যথার কাব্য। ইঞ্জুরি তার জীবনকে এক অবিরাম যন্ত্রণার মাঝে নিমজ্জিত করেছে, তবে তার অন্তরের প্রার্থনা একটাই—ফিরে আসার।
এই পথ যেন শেষ নয়, বরং এক নতুন শুরুর আর্তনাদ।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন:
একান্ত গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে বেড়ে ওঠা মাসুদের জীবনের শুরুটা যেমন সাধারণ, তেমনি অসাধারণও। ১৪ অক্টোবর ২০০৫ সালে কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই ছেলেটি ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি এক অদম্য আকর্ষণ অনুভব করত। তার বাবার সাথে স্থানীয় বাজারে পান বিক্রির ছোট্ট কাজের মাঝেও ফুটবল তার স্বপ্নের ধ্রুবতারা হয়ে ছিল। মাসুদ শংকর মাধবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছে, এবং পরে চর রাজিবপুর টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজে ভর্তি হয়। পড়াশোনা চললেও ফুটবল যেন ছিল তার অস্তিত্বের এক অপরিহার্য অংশ, যার প্রতি ছিল গভীর আবেগ ও ভালোবাসা।
ফুটবলে সাফল্যের ধারায় উত্তরণ: স্থানীয় একটি টুর্নামেন্টের মধ্যে দিয়ে মাসুদের প্রতিভা প্রথমবার সকলের নজরে আসে। তার অসাধারণ খেলার দক্ষতা দেখে সবাই বুঝতে পেরেছিল—এই ছেলেটি একদিন বড় কিছু করবে। রাজিবপুর উপজেলা ফুটবল টিমের হয়ে বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে সে দুবার দলকে চ্যাম্পিয়নের মুকুট এনে দেয়। তার নৈপুণ্য ছিল অসাধারণ, তার পায়ের প্রতিটি স্পর্শ যেন সোনায় মোড়ানো।
একের পর এক মাঠে খেলা করে সে প্রমাণ করেছে তার দক্ষতা। জেলার বিভিন্ন জায়গায়, রাজিবপুর থেকে রৌমারী, থেকে দেওয়ানগঞ্জ , বকশিগঞ্জ পর্যন্ত তার খেলার ঝলক চোখে পড়েছে অসংখ্য মানুষের। শংকর মাধবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তঃবিদ্যালয় টুর্নামেন্টে সে হয়ে ওঠে মাঠের অবিসংবাদিত নেতা।
ইঞ্জুরি, জীবনের নিষ্ঠুর অধ্যায়: তবে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ সালের সেই কালো দিনটি মাসুদের জীবনের গতিপথকে পাল্টে দেয়। কোদালকাটি মাঠে খেলার সময় তার হাঁটুতে এমন একটি লিগামেন্ট ইঞ্জুরি হয়, যা তার শরীর ও স্বপ্নকে ভেঙে দেয়। এক মুহূর্তে যেন সব থমকে গেল। তার পায়ের শক্তি হারিয়ে গেল, আর সেইসাথে হারিয়ে গেল মাঠে ফিরে আসার সক্ষমতা। চিকিৎসার জন্য যতটা সম্ভব ছিল, নিজ উদ্যোগে করেছে, কিন্তু অভাবের সংসার তার উন্নত চিকিৎসার পথ আটকে দিল। রাজিবপুর উপজেলা প্রশাসন, যার হয়ে সে এতদিন খেলেছে, তাকে কোনো সহায়তা দেয়নি। তার আর্তনাদ যেন ব্যর্থতায় পরিণত হলো, আর সে নিঃশব্দে মাঠ থেকে দূরে সরে গেল।
আনন্দবাজার ফুটবল ক্লাব, নতুন এক পথের সূচনা: কিন্তু মাসুদ থামেনি। মাঠের বাইরেও তার ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা অম্লান রয়ে গেছে। ২০২১ সালে তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত ‘আনন্দবাজার ফুটবল ক্লাব’ এখন তার অবসর সময় কাটানোর জায়গা। তার স্বপ্ন এখন অন্যদের জন্য। নিজে খেলতে না পারলেও, সে ৩৬ জন কিশোরকে নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। তার হাত ধরেই ‘আনন্দবাজার ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এবং ‘আনন্দবাজার কিশোর ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এর তিনটি পর্ব সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই টুর্নামেন্টগুলো মাসুদের নেতৃত্বের প্রতীক, যেখানে সে নিজেকে দেখতে পায়, প্রতিদিন নতুন স্বপ্ন দেখায় তরুণদের।
এখন মাসুদ ক্লাবের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করছে। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সে নিশ্চিত করছে, তার মতো প্রতিভাবান ফুটবলার যেন একদিন মাঠে ফিরে আসতে পারে। তার নেতৃত্বে কিশোরদের মনোবল বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর তারা নতুন স্বপ্ন বুনতে শিখছে।
পারিবারিক দায়িত্ব ও সামাজিক অবদান: মাসুদের সংগ্রাম শুধুমাত্র ফুটবলেই সীমাবদ্ধ নয়। পরিবারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা বরাবরই ছিল অটুট। বাবার ব্যবসায় সে সাহায্য করে আসছে শৈশব থেকেই, এবং আজও বাজারে তার বাবার সাথে পান বিক্রি করে। পাশাপাশি সে যুক্ত থেকেছে পরিবেশ সচেতনতার বিভিন্ন উদ্যোগে, ‘সবুজায়ন সংগঠন’এর মাধ্যমে নিয়মিত বৃক্ষরোপণ করে আসছে এলাকায়। স্থানীয় জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সে নিজের উদ্যম এবং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
মাসুদ রানা, এক প্রতিভার নাম, যার জীবন যেন এক দুঃখের কাব্য, যার প্রতিটি ছত্রে লুকিয়ে আছে সংগ্রাম ও স্বপ্নের এক অমোঘ যাত্রা। ইঞ্জুরি তার শরীরকে থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার মনোবল আজও থামেনি। একদিন সে আবারো মাঠে ফিরবে—এই আশা তার হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে। সহযোগিতা আসুক বা না আসুক, তার আত্মবিশ্বাস তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ফুটবলের প্রতি মাসুদের এই অনুরাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের খেলোয়াড়ের জয় শুধু মাঠে নয়, হৃদয়ের গভীরতায় মাপা হয়। তার লড়াই হয়তো আজ শেষ হয়নি, তবে এই লড়াই তাকে একদিন নতুন বিজয়ের পথে নিয়ে যাবে। মাসুদ রানা—একটি নাম, যার জন্য আমরা গর্বিত। তার স্বপ্নের পথে আবারও এগিয়ে আসা, সেই দিনের অপেক্ষায় সবার মন।
Leave a Reply