ফরিদুল ইসলাম,নিজস্ব প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এক সাহসী কন্যার নাম মিম আক্তার। কঠিন পরিস্থিতি, আর্থিক সংকট, এবং সমাজের নানা কটুক্তির মাঝেও নিজের স্বপ্ন পূরণে একাগ্র এই মেয়ে। তার লক্ষ্য একটাই বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলে খেলে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা। চলুন, কুড়িগ্রাম সংবাদ-এর পক্ষ থেকে এই প্রতিভাবান ফুটবলারের সাথে এক অন্তরঙ্গ আলাপে আমরা তার সংগ্রামের কথা শুনি।
প্রশ্ন: মিম, একজন মেয়ে হিসেবে ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রেরণা কোথায় পেলেন?
মিম আক্তার: আমি ছোটবেলা থেকেই ফুটবল ভালোবাসতাম। কোদালকাটির মাঠে যখন ছেলেরা খেলত, আমি দূর থেকে দেখতাম। আমার ভেতরে একটা অদম্য আকাঙ্ক্ষা ছিল—একদিন আমিও মাঠে নামব, গোল করব। আমার পরিবার, বিশেষ করে বাবার সমর্থন, আমাকে সাহস দিয়েছে এই খেলা নিয়ে এগিয়ে যেতে। ছোটবেলা থেকেই বাবা আমাকে বলতেন, “তুমি তোমার স্বপ্নের পথে অটল থাকো, বাকি সব আমি দেখব।” তার এই কথাগুলো আমার জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন: পরিবারের পাশাপাশি অন্যদের কাছ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
মিম আক্তার: পরিবার সবসময় আমার পাশে ছিল, কিন্তু প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। তারা ভাবত মেয়েদের ফুটবল খেলা মানায় না, মেয়েদের জন্য ঘরের কাজই যথেষ্ট। অনেকেই বলেছে, “ফুটবল খেলে কী হবে? এর থেকে তো সংসার করা ভালো।” কিন্তু আমি এসব কথায় কান দিইনি। আমি জানি, যদি আমার স্বপ্ন পূরণ হয়, একদিন তারাই আমাকে সমর্থন করবে। আর বাবার কথায় সবসময় সান্ত্বনা পাই—তিনি বলতেন, “তোমার কাজই তোমার জবাব হবে।”
প্রশ্ন: আপনার বাবার ভূমিকা এবং তার ত্যাগ আপনার জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
মিম আক্তার: আমার বাবা মোঃ মন্জুরুল ইসলাম আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তিনি একজন পরিশ্রমী মানুষ, দিনরাত পরিশ্রম করে আমাদের সংসার চালান। তবুও তিনি কখনো আমাকে ফুটবল খেলার পথে বাধা দেননি। আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও আমার পড়াশোনা ও প্র্যাকটিসের খরচ মেটাতে তিনি সবসময় চেষ্টা করেন। বাবার এই ত্যাগ ছাড়া আমি আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম না। তার এই ত্যাগ আমাকে আরও দৃঢ় করেছে এবং তাকে গর্বিত করাই আমার মূল লক্ষ্য।
প্রশ্ন: নিজ এলাকা থেকে জেলা শহরে প্র্যাকটিস করতে যেতে হয় আপনাকে। কী কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন?
মিম আক্তার: আমাদের গ্রাম থেকে জেলা শহরে যাওয়া-আসা বেশ কষ্টকর। যাতায়াত খরচ অনেক বেশি, এবং শহরে থেকে প্র্যাকটিস করার জন্য থাকার জায়গাও পাওয়া কঠিন। তাছাড়া খাবার, যাতায়াতের খরচ সব মিলিয়ে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই সমস্ত সমস্যাকে আমি কোনোদিনই বাধা মনে করিনি। আমার মন সবসময় একটাই কথা বলে—“যতই কষ্ট হোক, একদিন তা সার্থক হবে।” আমি জানি, কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কোনো স্বপ্ন পূরণ হয় না।
প্রশ্ন: মেয়েদের ফুটবল নিয়ে সমাজের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আপনার কী মতামত?
মিম আক্তার: সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পুরোপুরি পরিবর্তন হয়নি। মেয়েদের খেলা দেখলে অনেকেই প্রশ্ন তোলে, অনেকেই মেয়েদের খেলাধুলাকে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সময়ের সাথে সাথে এই ধারণা পরিবর্তন হবে। আমি আমার কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে চাই, মেয়েরাও দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনতে পারে। মেয়েদের জন্য সঠিক সুযোগ তৈরি হলে, আমরাও জাতীয় দলের অংশ হতে পারব এবং দেশের পতাকা বিশ্বমঞ্চে উড়াতে পারব।
প্রশ্ন: আপনি এখন যে একাডেমিতে অনুশীলন করছেন, তার সম্পর্কে কিছু বলুন।
মিম আক্তার: আমি এখন কুড়িগ্রামের স্বনামধন্য ক্রীড়া সংগঠক, ফুটবল বিপ্লবী জালাল হোসেন লাইজু স্যারের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত ‘লাইজু কিডস ফুটবল একাডেমি’ তে অনুশীলন করছি। এখানে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করছি, যাতে আমি আমার স্বপ্নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি। একাডেমির কোচ এবং অন্যান্য খেলোয়াড়দের সাথে অনুশীলন করে আমি প্রতিনিয়ত আরও শিখছি। একাডেমির পরিবেশ এবং প্রশিক্ষণ আমাকে উন্নত করছে, এবং আমার বিশ্বাস, এখান থেকেই আমি আমার পরবর্তী ধাপে পৌঁছতে পারব।
প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন কী?
মিম আক্তার: আমার একমাত্র স্বপ্ন, বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলব। আমি চাই, বিশ্বের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের সাথে মাঠে প্রতিযোগিতা করতে। আমার বিশ্বাস, সঠিক সুযোগ পেলে মেয়েরাও বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখতে পারবে। আমি চাই আমার গ্রামের মেয়েরা আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হোক এবং ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নিক।
প্রশ্ন: কুড়িগ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে কী করা উচিত বলে মনে করেন?
মিম আক্তার: প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের জন্য খেলাধুলার অবকাঠামো খুবই সীমিত। যদি স্থানীয়ভাবে ফুটবলের একাডেমি ও প্র্যাকটিস সুবিধা বাড়ানো যায়, তাহলে এখান থেকেও দেশের জন্য অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরি হবে। আমি আশা করি ভবিষ্যতে সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান এ দিকে নজর দেবে।
প্রশ্ন: আপনার পরামর্শ কী, যারা আপনার মতো ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিতে চায়?
মিম আক্তার: আমার পরামর্শ, কখনো হাল ছেড়ো না। সমাজের কথায় কান না দিয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হবে। কঠিন পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর স্বপ্নের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সবকিছু সম্ভব। ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটি একটি যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে যারা জয়ী হতে চায়, তাদের কখনো হার মানা উচিত নয়। আমি বিশ্বাস করি, সঠিক মনোভাব থাকলে যেকোনো মেয়ে সফল হতে পারে।
মিম আক্তার কেবল একজন ফুটবলার নন, তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং স্বপ্নের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যিকার চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমরা মিমের জন্য শুভকামনা জানাই, এবং বিশ্বাস করি, সে একদিন বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়ে দেশের পতাকাকে বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল করবে।
Leave a Reply