ফুলবাড়ি (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: সেতু নির্মাণের মেয়াদ এক বছর। অজানা কারণে সাড়ে তিন বছরেও শেষ হয়নি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার খোচাবাড়ী – কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা সড়কের তালতলায় ধরলার খালের ওপর সেতুর নির্মাণ কাজ। কবে সেতুর নির্মাণ শেষ হবে তা নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই স্থানীয় লোকজনের।ঢিমে তালে কাজ চলায় স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে খাল পারাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করায় দুর্ভোগে পড়েছেন পথচারীরা।বাধ্য হয়ে স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে ড্রামের ভেলায় দড়ি টেনে পারাপার হচ্ছেন।এতে নানা বিড়ম্বনা ও ঝুঁকির শিকার হচ্ছেন তারা। ফুলবাড়ী উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) জানায়, নির্মাণাধী সেতু স্থানে ধসে পড়া সেতু অপসারণ এবং খালে পানির গভীরতা বেশি থাকায় সময় বেশি লেগেছে। ইতোমধ্যে পাইলিং শেষে এপার্টবেজ হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়,২০১০ সালে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই স্থানে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেতুর পাইলিং না থাকায় ২০১৭ সালের বন্যার পানির তোড়ে সেতুর নীচ ও দুই পাশের সংযোগ সড়কের মাটি সরে ধসে পড়ে সেতুটি। সেই থেকে বিপাকে পড়েন দুই পাড়ের ২০ গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ।খাল পারাপারে স্থানীয়রা কখনো বাঁশের সাঁকো, ড্রামের ভেলা আবার নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। পানি বাড়লে দুর্ভোগ বাড়ছে।
স্থানীয়দের দাবি ও বহু আবেদন নিবেদনের পর ফুলবাড়ী উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ( এলজিইডি) পুরাতন সেতুর ধসে পড়া অংশ অপসারণ করে ওই স্থানে আর একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম সড়কে অনূর্ধ্ব ১০০ মিটার সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৪২ মিটার দৈর্ঘ্যের নতুন এ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ২কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কুড়িগ্রাম
সদরের ঘোষ পাড়ার নুপা জেডএইবি জেবি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণের কাজ পায়। কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল। কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল। স্থানীয়রা জানায়, কার্যাদেশ পাওয়ার ৬ মাস পর ঠিকাদারের লোকজন ওই এলাকার উত্তর প্রান্তে কিছু পাথর রেখে ও টিনের চালা করে উধাও হয়ে যায়। এক বছর পরে এসে আবার কিছু রড রেখে একজন নিরাপত্তা কর্মী রেখে যান। এভাবেই কেটে যায় দুই বছর। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয়রাসহ জনপ্রতিনিধি এলজিইডিকে চাপ দেওয়ায় এ বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু হয়। তিন মাস কাজ শেষে বন্যার সময় বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিন গত বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার খোঁচাবাড়ি গ্রামে নির্মাণাধীন সেতু এলাকায় দেখা যায়, সেতুর দুই প্রান্তের দুইটি পিলারের ভিত্তি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। তাও পানিতে ডুবে আছে। শুধু রড দেখা যায়। একটা শূন্য চালা ঘর থাকলেও ঠিকাদারের কোনো লোক নেই। ঠিকাদার খাল পারাপারে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করায় স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত ড্রামের ভেলায় দড়ি টেনে লোকজন পারাপার হচ্ছেন।
খোচাবাড়ি গ্ৰামের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মালেক সরদার জানান, তালতলার খোচবাড়ি -হলোখানা সংযোগ খালের উত্তরের বোয়াইলভীড়, নেওয়াশী, নগরাজপুর,ফুলবাড়ী সদর,খোলাহাট, পাখিরহাট,রাবাইতাড়ি,খড়িবাড়ি,আটিয়াবাড়ি সুজানেরকুটি শ্যামপুর এবং দক্ষিণের চরখোচাবাড়ি,হলোখানা, কাশেম বাজার, আলিপুর, রাঙামাটি,কাগজিপাড়া এবং ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের ৬ গ্রামের অর্ধ লক্ষাধীক মানুষ প্রতিদিন এ পথেই কুড়িগ্রাম জেলা ও ফুলবাড়ী উপজেলা সদরে যাতায়াত করে। এছাড়াও এসব অঞ্চলের ৫০টিরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় কৃষক, ব্যবসায়ী, চরখোচাবাড়ি আবাসনের বাসিন্দা এবং পথচারীরা কৃষিপণ্য,ব্যবসার মালামাল, বাজার সদাইসহ নানা কারণে এ পথেই চলাচল করেন।
ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের নগরাজপুর গ্রামের কৃষক জামিল উদ্দিন, সোহরাব আলী, মোস্তাক মিয়া এবং রুহুল আমিন জানান, চলাচলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ড্রামের ভেলা দিয়ে সাইকেল, মোটরসাইকেল ও ভ্যান ছাড়া অন্য কোন যানবাহন যাতায়াত করতে পারে না। মালামাল বহন করা যায় না । মালামাল বহন করতে উপজেলার পাখিরহাট নয়তো খড়িবাড়িহাট হয়ে ২০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয় ।
খোচাবাড়ির ৭ নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ( ইউপি) সদস্য আহমদ আলী বলেন, তার ওয়ার্ডের শেষ সীমানায় তালতলায় নির্মাণাধীন সেতুটির কাজ ঢিমেতালে হচ্ছে। কবে শেষ হবে কেউই বলতে পারেন না।
খুব সাবারি গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, এপারের অনেক কৃষকের জমিজমা ওপারে আছে। জমি চাষবাস, শাকসবজি,ফসল ফলানো, গরুছাগল আনা নেওয়ার জন্য দিনে ১০ বার এপার ওপার করতে পানি পথে খাল পার হতে হয়। সেতু নির্মাণে বিলম্ব হওয়ায় নানা ভোগান্তির শেষ নেই। নগরাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মেরাজ হাসান বলেন, আমরা কয়েকজন বন্ধু পেরিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করি। পানি বাড়লে অনেক সময় ভেলা থেকে পড়ে অনেকের জামা কাপড় ও বই ভিজে যায়। নগরাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুল হক বলেন, চরখোচাবাড়ি থেকে প্রতিদিন খাল পেরিয়ে স্কুলে যাতায়াত করি। অনেক সময় স্কুল আসতে দেরি হয়।
খোলাহাট বাজারের ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ী মিঠু মিয়া, নুর হাসান সরদার বলেন, গ্ৰামের বাড়ি ঘুরে ধান কিনি। খালের ওপাড়ে ধান আনা নেওয়ার অসুবিধার কারনে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।
খোঁচাবাড়ি গ্রামের কাসেম আলী বলেন বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লে গরুছাগল নিয়ে এপার-ওপার করতে ভোগান্তি বাড়ে। আমরা অসহায় হয়ে পড়ি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার ফরহাদ হোসেন বলেন, ওই খালে শুষ্ক মৌসুম ছাড়া কাজ করা যায় না। বৃষ্টির হলে পানি জমে। এছাড়া পুরোনো সেতু অপসারণ সময় লেগেছে। আশা করছি এই সিজনে কাজ শেষ হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নুপা জেডএইবি জেবির সত্ত্বাধিকারী লুৎফর রহমান রণির বক্তব্য জানার জন্য তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল ধরেননি।
জানতে চাইলে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মামুনুর রহমান বলেন,দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার পর এবছরের জানুয়ারি মাসে নতুন করে কাজ শুরু হয়। বর্ষার কারনে বর্তমানে কাজ বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।আগামী শুকনা মৌসুমে শেষ হতে পারে।
Leave a Reply