ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক ও তাদের অনেকের বসতবাড়িসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার খবর পাওয়া গেছে। স্বল্প পরিসরে হলেও কুড়িগ্রামও এমন রাজনৈতিক আক্রোশের আগুনে পুড়েছে এবার। সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে দলবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপর ‘জুলুম-নিপীড়ন’ করেছেন এমন নেতাকর্মীরাই আক্রোশের শিকার হয়েছেন। হামলার শিকার হয়েছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বেশকিছু রাজনৈতিক কর্মী এবং তাদের পরিবার। রাজনৈতিক আক্রোশের জেরে সংঘটিত এসব হামলাকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে ‘সংখ্যালঘুর ওপর হামলা’ বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।
৯ আগস্ট এই দুই সংগঠন কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত তালিকায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের রাবাইতারি গ্রামের মনোরঞ্জন সেন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। সরেজমিন মনোরঞ্জন সেনের বাড়িতে গিয়ে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে মনোরঞ্জন সেনের ছোট ভাই চিত্তরঞ্জন সেনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হামলায় বাড়ির কিছু জিনিসপত্র ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও সেখানে লুটপাটের কোনও ঘটনা ঘটেনি।
বুধবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে রাবাইতারি গ্রামে মনোরঞ্জন সেনের বাড়িতে গেলে তার দেখা মেলেনি। মনোরঞ্জনের পুত্রবধূ লাবন সরকার মানসি বলেন, ‘ ঘটনার দিন বাবা (শ্বশুর) বাড়িতে ছিলেন না। চাচা শ্বশুরের (চিত্তরঞ্জন সেনের) বাড়িতে হামলা করার সময় আমাদের বাড়িতে হামলার চেষ্টা করেছিল। ঢিলে একটি জানালার কাঁচ ভেঙে যায়। কিন্তু শ্বশুর একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জানার পর আর হামলা করেনি।’
হামলা ও ভাঙচুরের শিকার চিত্তরঞ্জন সেন জানান, ‘৫ জুলাই বিকালে বিএনপি সমর্থক এলাকার কিছু লোকজন- যাদের বেশিরভাগই ছেলেপেলে, তারা বাড়িতে হামলা করে। কিছুক্ষণ ভাঙচুর করার পর আমি তাদের অনুরোধ করি আর ভাঙচুর না করতে। তখন তারা চলে যায়। আমাদের গ্রামে আরও কয়েকটি পরিবারে হামলা হয়েছে। তবে তারা মুসলিম পরিবার।’
কেন হামলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত কিনা, এমন প্রশ্নে চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘ কেন হামলা করেছে আমি জানি না। আমি কৃষক মানুষ, রাজনীতি করি না। আওয়ামী লীগে ভোট দেই। আমার ছেলে শুভ্রজিৎ। সে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিল। তবে সে ২০২২ সালে ইস্তফা দেয়। আক্রোশ আমার ছেলের ওপর নাকি আমার ওপর সেটা জানি না।’
‘বাড়িতে শুধু আমি ছিলাম। তারা আমার ওপর হামলা করেনি। আমি অনুরোধ করেছিলাম ভাঙচুর না করার। পরে তারা চলে গেছে। আমার দোকানেও হামলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির লোকজন তা হতে দেয়নি। পরে তাদের সহায়তায় দোকান খুলেছি। যাদের ইন্ধনে হামলা হয়েছে তারাই আবার এখন এসে সান্তনা দিচ্ছে।’ যোগ করেন চিত্তরঞ্জন।
রাবাইতারি গ্রামে প্রায় দুই থেকে তিন শত হিন্দু পরিবারের বসবাস। চিত্তরঞ্জন সেনের বাড়িতে হামলা হলেও তার প্রতিবেশী অন্য কোনও হিন্দু পরিবার হামলার শিকার হয়নি। একই গ্রামে হামলার শিকার হয়েছেন দিনমজুর আব্দুস ছামাদ ও নজির হোসেন। সামাদের ছেলে রাসেল এবং নজিরের ছেলে সবুজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। মূলত ছেলেদের রাজনৈতিক আদর্শের কারণে এই পরিবারগুলো প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে। তারা বলছেন, এসব হামলা রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক নয়।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অনীল চন্দ্র রায় বলেন, ‘ উপজেলায় শুধু একটি হিন্দু পরিবার হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। সেটা সাম্প্রদায়িক হামলা নয়। রাজনৈতিক কারণে হামলা হয়েছে। তবে সেখানে কোনও প্রতিমা ভাঙচুর বা লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।’
‘এই হামলাকে সাম্প্রদায়িক বা সংখ্যালঘুর ওপর হামলা বলার কোনও সুযোগ নেই। আমি স্থানীয় প্রশাসনকেও একই মত দিয়েছি। তবে আমরা কোনও ধরণের হামলাকেই সমর্থন করি না। রাজনৈতিক হামলাকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে কেউ ফায়দা হাসিল করতে চাইলে তার নিন্দা জানাই।’ যোগ করেন এই ঐক্য পরিষদের নেতা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পরপরই কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে।
রৌমারী উপজেলায় কুড়িগ্রাম – ৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বাড়ি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তার মালিকানাধীন কয়েকটি ট্রাক ও জিপ গাড়ি আগুনে পুড়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও তার মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে।
একই উপজেলার বাসিন্দা ও সদ্য সাবেক এমপি বিপ্লব হাসান পলাশের বাড়িতেও ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।
হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে সদর, ভূরুঙ্গামারী, চিলমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ী উপজেলার আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। তবে সরকার পতনের পর হওয়া এসব হামলায় হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
Leave a Reply