রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ নজরদারিতে স্বল্প সময়ে ছিটমহলের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়ন এবং এর ভূখণ্ড ও নাগরিকদের বাংলাদেশের মূলধারায় যুক্ত করে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের অভ্যন্তরের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার মানুষের জীবনমান, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা,স্বাস্থ, যোগাযোগ, দক্ষতাসহ সামগ্ৰিক বিষয়ে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।
এক সময়ের অজ গাঁ থেকে রুপান্তর হয়েছে শহরে। উন্নয়ন দেখলে মনে হয় অর্ধেক নগরী, অর্ধেক কল্পনা । কল্পনার চেয়ে বেশি প্রাপ্তিতে মুছে গেছে এর অধিবাসীদের ৬৮ বছরের অপ্রাপ্তি,বঞ্চনা ক্ষত। ভূলে গেছে কষ্ট, অসহায়ত্ব ও নিপীড়নের দুঃসহ অতীত স্মৃতি। উন্নয়নের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ,প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি,কর্মসংস্থান এবং পুঁজির যোগান পেয়ে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দাসিয়ারছড়াবাসি এখন শুধু স্বালম্বী নয় বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ । আর তা সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় ।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় অবকাঠামো উন্নয়ন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গত ৯ বছরে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ,পাকা রাস্তা, মসজিদ, মন্দির,শশ্মান,ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, কম্পিউটার ল্যাব , শহীদ মিনার, গভীর ও অগভীর নলকূপ, পাওয়ার টিলার ট্রাক্টর,মাড়াই ও রোপন যন্ত্র,ডিজিটাল ইম্প্লয়মেন্ট সাব-সেন্টার(ডি-সেট সেন্টার), কমিউনিটি ক্লিনিক, সরকারি ও বেসরকারি স্কুল,কলেজ,মাদরাসা,ক্রীড়া ক্লাব, পাঠাগার,কমিউনিটি রির্সোস সেন্টার, গভীর অগভীর সেচ পাম্প, স্বাস্থ্য সম্মত স্যানাটেশন ব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানীয় জল,আশ্রয়নের ঘর এবং দক্ষ জনশক্তি ও কর্মসংস্থানে যুব প্রশিক্ষণ । এখন হাতের নাগালে বাজার। পাচ্ছেন সার, বীজ, কীটনাশক ,বাফার গুদাম, ওষুধ।পেয়েছেন ভূমির মালিকানার পরচা ও স্মার্ট জাতীয় পরিচয় পত্র । ভোট দানের অধিকার। সরকারি চাকরি। তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ডি-সেট সেন্টার চালু করেছে আইসিটি বিভাগ। এখান থেকে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবা থেকে পাসপোর্ট ও ভিসা আবেদন অনলাইনে করা যাচ্ছে । মোবাইল ব্যাংকিং আর ভিডিও কনফারেন্সেরও সুযোগ রয়েছে।
দাসিয়ারছড়ার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হোসনে আরা খাতুন,জলি আক্তার ও কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুজাতা খাতুন জানায়,আগে আমাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। আমাদের বড় বোনেরা লেখাপড়া করতে পারে নাই। ছিটমহলে চলাচল করতে হতো জমির আইল (আল পথ) দিয়ে।কখন কী হয় ভেবে বাবা মা বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি। ১০-১২ বছরে বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাড়ির পাশে বিদ্যালয়। পাকা রাস্তা ধরে হেঁটে অথবা সাইকেলে অন্যদের সাথে বিদ্যালয়ে যাই।বিনা মূল্যের বই ছাড়াও, উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে পড়ালেখা করতে পারছি ।
বিলুপ্ত এ ছিটমহলের সাবেক পঞ্চায়েত প্রধান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিনিময়ের আগে দাসিয়ারছড়ায় জমা জমি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা খুনখারাবি লেগে থাকতো । আইনশৃঙ্খলার চরম বিপর্যয় ছিল। যেকোনো সমস্যা সমাধানে পঞ্চায়েত বিচার-সালিশ করতো। আর্থিক জরিমানা করতো।কেউ মানতো আবার কেউ মানতো না । এখন আইনের শাসনে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। শান্তিতে আছি ।
কামালপুর গ্ৰামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, এখানে‘বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের বসবাস। তারা ও আমরা অনেক কষ্ট করে বাস করেছি। এখন হাতের নাগালে রাস্তা ঘাট, সেতু, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, ক্লিনিক। এখানকার ব্যাংকে টাকা জমা রাখছি। প্রয়োজনে তুলছি। ঝুঁকি না নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি।
সমন্বয় পাড়ার সানজিদা বেগম(৩৬)। কুড়িগ্রাম যুব প্রশিক্ষন কেন্দ্রে কাপড় কাটিং ও সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন।এরপর রংপুর অগ্রণী ব্যাংকের সহায়তায় ১০টি সেলাই মেশিন ও পুঁজি পেয়ে কাপড়ের দোকান এবং সাথে কাটিং ও সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেন। কাপড় বিক্রি এবং সেলাই থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে দুই সন্তানসহ চারজনের জীবন সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হাবিবপুরের আকলিমা,বড়ছোটকামাতের জোহরা,বালাতাড়ির আমেনা এবং বানিয়াপাড়ার সাহেরাসহ আরও ২৫ জন অসহায় ও দুস্থ মহিলা কাজ শিখে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়েছেন । তারা বলেন, সেলাইয়ের কাজ করে যা আয় করছি,তা দিয়ে সংসারে টুকিটাকি খরচ ছাড়াও ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ চলছে ।
যে মেয়েরা আগে ঘর থেকে বের হতে না। এখন তারা দল বেঁধে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে । তাও সাইকেলে । দাসিয়ারছড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী জাহানারা বেগম বলেন, সমন্বয় পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় তার বাড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে । কখনও হেঁটে আবার কখনও রিক্সায় যাতায়াত করতেন ।এতে সময় মতো স্কুলে পৌঁছতে পারতো না । এখন তার সহপাঠী নুর নাহার, সামসুন,লুবা, জেসমিন,মুক্তিসহ ১০ জন এক সাথে সাইকেলে বিদ্যালয়ে সহজে যাওয়া আসা করে। এতে শুধু সময় নয় অর্থ ব্যয় কমেছে।
দাসিয়ারছড়ার হাবিবপুরের আম্বিয়া, সাহেদা, সোবহান, সাইদুল, মতিয়ার, জহরুল,ওসমান ছিটমহল বিনিময়ের আগে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতের দিল্লি ও হরিয়ানার বিভিন্ন ইট ভাটায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ভিন দেশে থাকতে কষ্ট হতো। ছিটমহল বিনিময়ের পর বাড়িতে ফিরে জমানো টাকায় ২৫ জন মিলে দাসিয়ারছড়ার দোলাটারীতে নিজেরা একটি ইটভাটা দেন। তাদের হাতে তৈরি ইটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন। নিজের আশ্রম দেওয়া য় প্রত্যেককে দৈনন্দিন১০০০ থেকে ১১০০ টাকা আয় করছেন।
ছিটমহল বিনিময়ের আগে দাসিয়ারছড়ার ছিল মাদকের আড়ৎ। ভারত থেকে ফেনসিডিল এসে অতি বাড়ীতে জমা হতো। পরে এসব ফেনসিডিল বিভিন্ন রুট দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিঘ্নে চলে যেত। প্রত্যেকের বাড়িতে চাষ হতো গাজা । বাংলাদেশের বিভিন্ন পাইকারি সব গাজা কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতো। রাশমেলা গ্ৰামের ডলি আক্তার(৫৪),আয়শা বেগম(৫৫).লাইলী বেগম (৩২)সহ শতাধিক নারী-পুরুষ হয়ে যান মাদক ব্যবসায়ী । এখন বাংলাদেশী হওয়ায় সমস্ত মাদকের ব্যবসা বিলীন হয়ে গেছে। এদের অনেকেই এখন চাকরি ব্যবসা এবং কৃষির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কেঁচো (ভার্মি কম্পোষ্ট)সার উৎপাদন করে সবার নজরে এসেছেন দাসিয়ারছড়ার হাবিবপুরের কৃষানী সাবিহা (৬৫),সালেহা(৫৪),মজিরণ(৩৪) এবং সাজেদা (৩২)। সার বিক্রি করে মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় করছেন ।এ সার ব্যবহার করে বাড়ির আঙিনায় চাষ করছেন শাকসবজি, জিংক সমৃদ্ধ ধান,পেঁপে,পেয়ারা,লেবু, ঝিঙ্গে।কামালপুর গ্রামে স্থাপন করা হযেছে কৃষক উন্নয়ন ক্লাব। এর চত্ত্বরে বিষমুক্ত সবজির বাজার করা হয়েছে । প্রতিদিন এখানে ই ভালোই বেচাকেনা চলে। উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখন এ বাজারের সবজির ক্রেতা। অন্যান্য ৩৫ জনের সাথে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ট্রেনিং পেয়েছেন হাবিবপুরের কুলসুম (৩২) । তিনি বলেন,সকিনাসহ ১শ জনকে আমি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে হাতেকলমে শিখিয়েছি ।
চাকুরির আশায় বসে না থেকে যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একই পুকুরে হাঁস ও মাছ চাষ করছেন জোলানির ঘাটের যুবক আনোয়ার হোসেন(২৬)। তার দেখাদেখি কালিরহাটের জাকির (৩২),বালাতাড়ির নুর আলম(৩১) সমন্বয় পাড়ার মনির হাসান (৪২) ও বোর্ডেরহাটের জামাল হোসেন(৪৫) এখন সফল মৎস চাষী। তারা বলেন, আমরা প্রথমে দালাটারীর পুকুর লিজ নিয়ে যৌথ মৎস খামার করি ।প্রথমে লাভ তেমন হয়নি ।এখন খরচ বাদে মাসে জন প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে ।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় আন্দোলনের বাংলাদেশ অংশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খান বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি করেন ।এর সফল বাস্তবায়ন করে ছিটবাসীকে মুক্তি দিয়েছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে জীবনমানের উন্নয়ন করেছেন।
ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের(ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন,বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নজরদাড়িতে গত ৯ বছরে দাসিয়ারছড়ায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করা হয়েছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর করে জীবন মানের ব্যাপক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
উপজেলা র্নিবাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)রেহেনুমা তারান্নুম বলেন,দাসিয়ারছড়াবাসি এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।একদিকে উন্নয়ন অন্যদিকে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে তারা এখন দক্ষ, আত্মর্নিভরশীল এবং স্বাবলম্বি ।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের ভিতরে অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরাধীন এলাকা ছিটমহল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে ছিটমহলবাসী নাগরিকত্বহীন হয়ে দূবিষহ জীবন যাপন করত। ২০১৫ সালের আগে ভারত -বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৬২টি ছিটমহল ছিল অসহনীয় এক মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক । এসব ছিটমহল বিনিময়ে ১৯৭৪ সালের ১৬মে ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং বর্তমান সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৬ জুন নরেন্দ্র মোদি -শেখ হাসিনার চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তির আলোকে ২০১৫সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে পরাধীন এলাকা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের । ১আগষ্ট ১৫০ নম্বর দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশে যুক্ত হয়।নীলকমল নদী বেষ্টিত বিলুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের আয়তন ৬.৬৫ বর্গকিলোমিটার, যার অবস্থান ফুলবাড়ী উপজেলার ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়ন, কাশিপুর ইউনিয়ন ও ভাঙ্গামোর ইউনিয়নের মঝে বিদ্যমান। ২০১৫ সালের ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ হেট কাউটিং রিপোর্ট অনুসারে জনসংখ্যা ৬৫২৯ জন ও ১৩৬৪টি পরিবার রয়েছে।
Leave a Reply