বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো এমন বিপর্যয় যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হয়ে থাকে এবং তাতে মানুষের সরাসরি কোন ভূমিকা থাকে না। বাংলাদেশে কম – বেশি সারা বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ভূমিধস, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এদেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং অতি পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল বন্যা। বন্যা হচ্ছে এমন একটি দুর্যোগ যাতে খাল – বিল, নদী – নালা ইত্যাদির পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমভূমিতে আছড়ে পড়ে। প্রায় প্রতিবছর বন্যায় প্লাবিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। বিশেষকরে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো। জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং উত্তর – পূর্ব অঞ্চল সিলেটের বিভিন্ন জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।
এবছর বন্যায় কুড়িগ্রামের ৭২টি ইউনিয়নের ৫৫ টি বন্যায় কবলিত হয়েছে, কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে এবং ৩৪১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে বিলীন হয়ে গেছে দরিদ্র কৃষকের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম কৃষি ফসল। পাট, ধান এবং চর অঞ্চলের কাউন, তিল, ডাল ইত্যাদি সকল ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। একদিকে কিছু দিন আগে তীব্র তাপদাহ ও দীর্ঘ খরায় কৃষকরা ফসল চাষ করতে পারেনি অন্যদিকে যতটুকু চাষ করেছিল তা এখন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে, এতে হাজারো কৃষক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।
এছাড়াও বন্যার্ত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়, পানিতে ডুবে প্রাণ হারায় অনেক শিশুর, মৃত্যু ঘটে অসংখ্য গবাদিপশুর। বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যাহত হয় সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা অনাহারে – অর্ধাহারে নির্ঘুম রজনী কাটে অগণিত মানুষের। সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বাজেট হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তা সুষ্ঠ বন্টন করে না, এমনকি কখনো কখনো তাদের বিরুদ্ধে ত্রাণ আত্মসাৎ এর অভিযোগ ওঠে। যারফলে প্রত্যন্ত এলাকার বানবাসি মানুষেরা ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়।
গত ৬ জুলাইয়ের কুড়িগ্রাম সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি কুড়িগ্রাম জেলা সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা আমিনা বেগম বলেন ‘নৌকাত পাঁচ দিন ধরে আছি, বানের পানিতে কি রান্দি কি খাই? সারাদিন না খাইয়া আছি, মানুষের ভাড়া নৌকাত আজ চারদিন ধরে আছি। ক্যাইয়ো খোঁজ নেই নাই। বেটা ভেলা ধরি বাজার করে আনিল, এল্যা রান্দিবের বছি।’ আমিনা বেগমের পরিবারের মত অনেক পরিবার এরকম অনাহারে দিন যাপন করছে। বন্যায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাচ্চাদের জীবন, ঘরবাড়ির চারদিকে পানি তাই যেকোনো সময় পানিতে পড়ে বাচ্চাদের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা চিন্তিত অবস্থায় দিন গুণছে। কারণ প্রসব বেদনা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া কোনভাবে সম্ভব নয়। আরেকটি মারাত্মক অসুবিধা হলো চারোদিকে পানি থাকায় কেউ মারা গেলে লাশ দাফন করার কোন জায়গা পাওয়া যায় না অন্যত্র কোন গ্রামে দাফন করতে হয়। সর্বোপরি বানবাসি মানুষেরা এক অবর্ণনীয় কষ্টে মানবতার জীবনযাপন করে।
এরকম ভয়াবহ বন্যার কারণ হলো অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, নদী শাসনে ব্যর্থতা ইত্যাদি। তবে শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে বন্যা প্রতিরোধ করা করা সম্ভব। প্রথমত, নদী খনন করে নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে হবে জনবসতি এলাকার চারপাশে বাঁধ নিশ্চিত করতে হবে এবং বাঁধের চারপাশে দীর্ঘ শিকড়যুক্ত গাছ লাগাতে হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, একে অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা রাখতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস জানিয়ে দিতে হবে এবং দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় সতর্কতা জারি করতে হবে, যাতে করে মানুষ আত্মরক্ষার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে। সচরাচর যে এলাকাগুলোতে বন্যা হয়ে থাকে সেখানে উঁচু নলকূপ স্থাপন করতে হবে যেন বন্যার সময় বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করা যায়। বন্যায় কবলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন পরিবারই বঞ্চিত না হয়। শিশুদের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে যেন তারা পানিতে না যায়। ভ্রাম্যমান হাসপাতালে স্থাপন করতে হবে যাতে যেকোনো রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যায়। বন্যার পানির কমতে থাকলে দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয় তখন বানবাসীদের মাঝে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। মানুষ ডায়রিয়া, কলেরা ও ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় তাই বন্যা শেষে দ্রুত বর্জ্য অপসারনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেকোন অঞ্চলের জন্য অভিশাপ। বিশেষত বন্যা যেন উত্তরবঙ্গের কান্না। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর কিন্তু প্রতিবছর আগ্রাসী বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। বর্তমানে বন্যাকে দেশের অর্থনীতির উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দায়ী করা হয়। তাই বন্যা প্রতিরোধে রাষ্ট্র পক্ষ থেকে শুরু করে জনসাধারণ প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল ও জাতিগোষ্ঠীকে গুরুত্ব না দিলে দেশের সার্বিক উন্নতি অসম্ভব।
মমিনুল ইসলাম, শিক্ষার্থী ও লেখক (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়):
Leave a Reply