“সরু রাস্তাটার সাথে ব্রিজটা খুব একটা মানানসই দেখায় না, তবে ব্রিজটা এখানে বেশ প্রয়োজন বহন করে। এটা না থাকলে গ্রামের মানুষগুলো গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে এক কথায়। যদিও যখন ব্রিজ ভেঙ্গে যায় তখন ঠিকই নিচের জমিগুলো মাড়িয়ে হেঁটে চলে তারা। এখানে কেন যেন ব্রিজ টেকে না, বানানোর পর দুই কি তিন বছরেই ভেঙ্গে পড়ে। এটাই হয়ে আসছে বারবার।
ব্রিজে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালে প্রথমেই চোখ পড়ে হিজল গাছটায়। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের মাঝে গাছটা, আশেপাশে জনবসতি নেই। এ গাছটা নিয়ে নানা ঘটনা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। এমন কি দিনের বেলায়ও কোন বাপের বেটার সাহস নেই যে গাছটার কাছে একা যায়।
তবে সেই হিজল গাছ থেকে খানিকটা দূরের এই রাস্তাটা বহুল ব্যবহৃত। এ পথ দিয়েই পানসিনগর হাটে যায় হাটুরেরা। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার হাট হয় সেখানে। এ গ্রামের মানুষের যাবার মত আরো একটা হাট অবশ্য পাশেই আছে কিন্তু সেটা ছোট, সব কিছু পাওয়া যায় না সেখানে।
এ গ্রামের মাতব্বর বাদশার শ্বশুরবাড়ি পানসিনগর হাটের পাশেই। বৃহস্পতিবার হাট শেষে শ্বশুরবাড়িতে রাত কাটিয়ে শুক্রবার সকালে বাড়ি ফিরছিল বাদশা,
পথে গণির সাথে দেখা তার। গণি বলছিল,
– এইবাবে আর কত? আপনে কিছু একটো করেন।
– ক্যা, কি হইছে আবার?
গণি জানাল, মুন্সির ছেলের সাথে লালভানুকে কথা বলতে দেখেছে ঐ হিজল গাছের তলায়।”
উপন্যাসটির শুরুটা হয়েছে ঠিক এভাবেই। তবে বইটির একটি বৈশিষ্ট্য হল যে আপনি খুব সহজে অনুমান করতে পারবেন না, ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে। লেখকের জন্মস্থান রাজিবপুরের মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের পাটাধোয়া পাড়া গ্রামের এক সময়ের একটি সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি উপন্যাসটি লিখেছিলেন। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৭ এর বইমেলায়। এরপর গত ২০২০ বইমেলায় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
উপন্যাসটির অনেক জায়গা জুড়ে, বিশেষ করে শেষে রয়েছে কিছু মজার ঘটনা। আবার কিছু ছোট কথা যেমন, সেলিম পাগলা বাদশাকে বলছে, আপনের বাড়ির সামনে আখড়া, আপনে যান না ক্যা? এখানেও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি হাসতেই পারেন।
উপন্যাসটির বিভিন্ন পর্বে কোথাও প্রেম, কোথাও বিরহ, কোথাও আনন্দ, কোথাও বিষাদ বা সংঘাত, কোথাও অজানা শঙ্কায় ছুটে বেড়ায় গ্রামের মানুষ, এসব পাঠককে উপন্যাসের ভেতরে ডুবিয়ে রাখতে পারে।
“সেদিন দুপুরে বাহির বাড়িতে বাঁশের কিছু খড়ি কাটছিল বাদশা। বাদশার বাড়িটা ঘেঁষে চলে গেছে সড়কটা। গ্রামে মানুষের কখনো উপজেলার দিকে যেতে হলে এই সড়ক দিয়ে যেতে হয়, এছাড়া হাটে যেতেও এ সড়ক দিয়ে যেয়ে ব্রিজের সড়কে ওঠা যায়।
সড়ক থেকে রিজু ফকির জোর গলায় ডেকে বাদশাকে বলল,
– লালভানুক তালি জাগা দিলেন?
– মানে, কি কও তুমি?
রিজু ফকির জানাল, লালভানুর তালাকের পর সেদিন কোথায় যেন ছিল, পরের দিন চাঁন মিয়ার বউ তাকে আশ্রয় দিয়েছে। সে এখন ওই বাড়িতেই অবস্থান করছে।
বাদশা শুধু কথাগুলো শুনল, কিছু বলল না। রিজু ফকিরের ঠোঁটের বক্র হাসিটা শুধু দেখে গেল বাদশা।
সে বাদশাকে এভাবে বলছে কারণ, চাঁন মিয়ার বাড়ি বাদশার বাড়ির ঠিক সামনের বাড়িটাই। রিজু ফকিরের এ বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসা আছে।”
এখানে দ্বিতীয় পর্বের বাদশা ও রিজু ফকিরের মধ্যে যে সংঘাতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে সে সংঘাত থেকেই উপন্যাসটির মূল ঘটনার সূত্রপাত হয়। পুরো উপন্যাসে কথোপকথনগুলো রাজিবপুরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়েছে।
উপন্যাসটির লেখক সোহান সরকারের জন্ম কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলার পাটাধোয়া পাড়া গ্রামে। লেখকের স্কুল জীবন কেটেছে জন্মস্থান রাজিবপুরে। মাধ্যমিকে পড়ার সময় তিনি স্কুল বিতর্ক দলের দলনেতা ছিলেন। স্কুল পেরিয়ে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে থেকে। লেখক সত্ত্বার বাইরে তিনি একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। শিক্ষা জীবনে তিনি এখন পর্যন্ত পদচারণ করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ খুব ছোট বেলা থেকেই। বইমেলা ২০১৬ তে লেখকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নয়নমণি’ প্রকাশ হয়। তার এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাত। লেখকের লেখা প্রথম শিশুতোষ বই “বাচ্চা বিড়াল” ছিল সে বছর বইমেলার আলোচিত একটি শিশুতোষ বই।
লালভানু উপন্যাসটি লেখকের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রকাশিত উপন্যাস যা তিনি তার উল্লেখযোগ্য লেখাগুলোর মধ্যে একটি বলে মনে করেন।
Leave a Reply