ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজ – ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও সরকারি বাংলা কলেজকে একত্রিত করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। এ ধরণের সিদ্ধান্তের পরামর্শদাতারা নিঃসন্দেহে দেশের জ্ঞানী, গুণী, প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী, বিচক্ষণ এবং সমাজের আলোকিত মানুষ।
আমি একজন ক্ষুদ্র শিক্ষক। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও কর্মস্থল মফস্বল শহরের ছোট্ট পরিবেশে। তাই আমার চিন্তা, চেতনা, ভাবনা ও জ্ঞানের পরিধিতে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকবেই। ফলে আমার ব্যক্তিগত মতামতে ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে সেজন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সাত কলেজের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার মনে একটি গল্প ভেসে উঠল।
প্রতীকী গল্পটি হলো:
এক গ্রামে এক কৃষক সাতজন সুন্দরী কন্যা নিয়ে সুখে-শান্তিতে বাস করতেন। তাঁদের কেউ সঙ্গীতে, কেউ পড়াশোনায়, কেউ খেলাধুলায়, আবার কেউ রান্নায় অসাধারণ দক্ষ ছিলেন। মেয়েদের এই গুণকীর্তন রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে শহরের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি কৃষককে পরামর্শ দিলেন—
“তোমার কন্যারা যদি আমার শহরের বাড়িতে থাকে, আমি তাদের আরও উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলব।”
তাঁর কথায় কৃষক কন্যাদের শহরে পাঠালেন। কিন্তু শিগগিরই দেখা গেল, শহরের লোকটির নিজেরই অনেক সন্তান থাকায় তিনি ওই সাত কন্যার প্রতি মনোযোগ দিতে পারছেন না। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অনাদরে কন্যারা মেধা ও মননে পিছিয়ে পড়তে লাগল। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিলেত থেকে কোনো ডিগ্রি অর্জন ছাড়াই নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে হলো।
এমন সময়ে এক সাধু বাড়িতে এসে সব শুনে বললেন “যদি মন্ত্রের মাধ্যমে সাত কন্যাকে এক কন্যায় রূপান্তর করা যায়, তবে যত্ন ও পরিচর্যা করা সহজ হবে এবং শিক্ষায় যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটবে।”
যেই ভাবা সেই কাজ সাত কন্যাকে মন্ত্রবলে এক কন্যায় রূপান্তরিত করা হলো। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল। এক হাতে খাবার নিতে গেলে অন্য হাত তা ফেলে দেয়, এক চোখ দিয়ে দেখতে চাইলে অন্য চোখ বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি অঙ্গ একে অপরের বিরোধিতা শুরু করল।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানালেন সাত রকম বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণে ক্রস সংকরায়নের ফলে উনপঞ্চাশ রকমের জগাখিচুড়ি আচরণ তৈরি হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর নাম ‘কনজেনিটাল বার্থ ডিফেক্ট’ বা জন্মগত সমস্যা।
এই গল্পের মতোই সাত কলেজের বর্তমান অবস্থা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ঢাকার এই সাত কলেজে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা চালু ছিল। পরবর্তীতে ডিগ্রি পাস, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স অন্তর্ভুক্ত হয়।
সারাদেশে সেশনজট কমাতে বিশেষ প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকার এই সাত কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৯৩ সাল থেকে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হয়।
ঢাকা মহানগরের শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা, দ্রুত পরীক্ষা, ফল প্রকাশ ও উন্নত একাডেমিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে সাত কলেজের আরও প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী যুক্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার সময়সূচি, ফলাফল প্রকাশ, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও সিলেবাস আপডেটে হিমশিম খেতে থাকে।
অন্যদিকে, সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সেশনজট, ফল প্রকাশে বিলম্ব ও একাডেমিক জটিলতা নিরসনের দাবিতে আন্দোলনে নামে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষার্থীরাও সাত কলেজকে আলাদা করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
২০২১ সালের দিকে এসব সমস্যার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় সাত কলেজকে পুনরায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এরপরের ঘটনা সবারই জানা।
ফলে রাজধানীর কেন্দ্রে থাকা স্বনামধন্য এই সাতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৭ এবং অদ্যাবধি মোট ৩২ বছর কেটে যাচ্ছে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ অবস্থায়। এরকম বিব্রতকর ভাগ্য অন্য কোনো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।
শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাদৃশ্য:
উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর শিক্ষার্থীরা সাধারণ, প্রযুক্তি, চিকিৎসা কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়। সেখানে ভর্তি হতে গেলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি বোঝাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ প্রযোজ্য। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ দরকার। যেমন, চিনিশিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হলো আখ চাষ, সার ও কীটনাশক; আর ফরওয়ার্ড লিংকেজ হলো মিষ্টি, বিস্কুট, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি।
আখের ফলন ভালো না হলে চিনির মিল চলবে না, আবার উৎপাদিত চিনি বাজারজাত না হলে উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হলো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, আর ফরওয়ার্ড লিংকেজ হলো কর্মসংস্থান বা উৎপাদন সেক্টর।
তাহলে যদি মানসম্পন্ন উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করা হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে।
সাত কলেজের গুরুত্ব:
ঢাকা কলেজসহ সাতটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় মেধা বিকাশ, সারা দেশের শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ সৃষ্টি, সমাজসচেতন নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজ দেশের নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় পথিকৃৎ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের জনমিতি অনুযায়ী, দেশটি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘তারুণ্য স্ফীতি’-এর মধ্যে রয়েছে। বিপুলসংখ্যক তরুণ এসব কলেজে পড়াশোনা করছে এবং বিদেশি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এই কলেজগুলোতে অধ্যয়ন করছে।
অনার্স ও মাস্টার্সে স্বল্প খরচে পড়াশোনার সুযোগ দিয়ে এ কলেজগুলো কেবল শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং সামাজিক উন্নতির সোপান হয়ে উঠেছে।
ইন-সিটু সমাধানের প্রস্তাব:
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত মত হলো—ইন-সিটু পদ্ধতিতেই সমাধান সর্বোত্তম।
ইন-সিটু সমাধান মানে হলো সমস্যাকে তার নিজস্ব প্রকৃতি, বাস্তবতা ও সীমার মধ্যেই সমাধান করা। অর্থাৎ কিছু যোগ-বিয়োগ নয়, বিদ্যমান কাঠামোকেই যুগোপযোগী করা।
ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় নামে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা সঠিক হতে পারে। তবে এর প্রশাসনিক কাঠামো হওয়া উচিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। সাতটি কলেজ যে অবস্থায় আছে, যেখানে আছে এবং যে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অধীনে আছে তা অপরিবর্তিত থাকবে।
ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস হবে আলাদা স্থানে। সেখান থেকে ভর্তি, পরীক্ষা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। পাঠদান, পরীক্ষা, উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা।
সিলেবাস প্রণয়ন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববিদ্যালয় করবে। নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে সেই বিষয়ের শিক্ষকদের পদ সৃষ্টি করে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। একইসঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক কার্যক্রমও আগের মতো চলমান থাকবে।
যাতে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে না জড়ায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
ধীরগতির প্রয়োগ জরুরি:
তবে একটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে—যুগোপযোগী করতে চাইলে পরিবর্তন আনতে হবে ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে। তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে তা হবে রূপকথার সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে একসঙ্গে সব ডিম পাওয়ার মতো সর্বনাশা পরিকল্পনা।
যেমন সরকারি কলেজগুলোতে বর্তমানে আইসিটি বিষয়ে বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তেমনি নতুন বিষয়ে শিক্ষকদের নিয়োগও সম্ভব।
আমাদের প্রত্যাশা যথাযথ কর্তৃপক্ষ সবদিক বিবেচনা করে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে এবং শিক্ষাঙ্গনের সম্পর্ক ও পরিবেশ দুটোই সুস্থ রাখবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
Leave a Reply