আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ইরানের রাজধানী তেহরানে শুক্রবার ভোররাতে পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এই হামলার আগে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি দ্রুত সম্প্রসারণ করছে—ক্রমবর্ধমান এই আশঙ্কার কারণেই মূলত এসব বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
২০১৫ সালে ছয় প্রভাবশালী দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে ইরানকে পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখার শর্ত দেওয়া হয়। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে তার দেশকে প্রত্যাহার করে নেন। এর পর থেকে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করেছে বলে মনে করা হয়। তবে ইরানের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইরানে মোট সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ছিল প্রায় ৯ হাজার ২৪৭ দশমিক ৬ কেজি বা ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি।
মোট মজুতকৃত ইউরেনিয়ামের মধ্যে ৪০৮ দশমিক ৬ কেজি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে ইরান, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে প্রযোজ্য সমৃদ্ধকরণের চেয়ে সামান্য কম। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে হয়।
আইএইএ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাত্ত্বিকভাবে ইরানের কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম রয়েছে, আরও কিছু পরিশোধন করলে তা দিয়ে দেশটি প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে।
তবে ইরান বরাবরই এ কথা অস্বীকার করে আসছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো অভিপ্রায় নেই বলে জানিয়েছে দেশটি।
নিচে ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার তালিকা দেওয়া হলো, যেগুলো জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক দল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে:
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
নাতাঞ্জ
তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি গভীরভাবে সুরক্ষিত (বাংকারযুক্ত) একটি স্থাপনা। কেন্দ্রটির অস্তিত্ব প্রথম সামনে আসে ২০০২ সালে।
নাতাঞ্জের দুটি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি সেন্ট্রিফিউজের সারি আছে। এর মধ্যে একটি কেন্দ্রের কার্যক্রম ভূগর্ভে পরিচালিত হয়। সেন্ট্রিফিউজ হলো এমন যন্ত্র, যা ব্যবহার করে ধাপে ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।
২০২১ সালের এপ্রিলে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্রে একটি হামলা হয়। এ হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করে ইরান।
শুক্রবার ভোররাতে এই কেন্দ্রে হামলা চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। কেন্দ্রটির পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত পরমাণুবিজ্ঞানীদেরও নিশানা করা হয়।
আইএইএ–এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিশ্চিত করেছেন, যেসব স্থান লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি নাতাঞ্জ।
ফোর্দো
মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গোপনে নির্মিত পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্র ফোর্দো ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়।
প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘জরুরি’ স্থাপনা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও পরে ইরান জানায়, এটি একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য মাটির নিচে এটি নির্মাণ করা হয়। এই কেন্দ্রে প্রায় তিন হাজার সেন্ট্রিফিউজ বসানো সম্ভব।
২০২৩ সালে এই কেন্দ্রে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া যায়। ইরানের দাবি, পরিশোধন প্রক্রিয়ায় অনিচ্ছাকৃত তারতম্যের কারণে এমনটি হয়েছে।
ইউরেনিয়াম রূপান্তর ও গবেষণা চুল্লি
ইস্পাহান
মধ্য ইরানের ইস্পাহান শহরে অবস্থিত এই ইউরেনিয়াম রূপান্তর কেন্দ্রে খনি থেকে উত্তোলিত অপরিশোধিত ইউরেনিয়ামকে ইউরেনিয়াম টেট্রাফ্লোরাইডে (ইউএফ৪) রূপান্তর করা হয়। এরপর সেটিকে রূপ দেওয়া হয় ফ্লোরাইডে (ইউএফ৬)। আর এটিকে সেন্ট্রিফিউজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজে ব্যবহার করা হয়।
২০০৪ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর এই কেন্দ্রে শিল্পপর্যায়ে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হয়।
ইস্পাহান কেন্দ্রটিতে একটি পারমাণবিক জ্বালানি প্রস্তুতকারক কারখানাও রয়েছে, যা ২০০৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্বল্প সমৃদ্ধ জ্বালানি উৎপাদন করা হয়।
২০২২ সালের জুলাইয়ে ইরান ঘোষণা দেয়, তারা ইস্পাহানে একটি নতুন গবেষণা চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।
আরাক
২০০০-এর দশকে খোন্দাব গ্রামের উপকণ্ঠে আরাক হেভি ওয়াটার গবেষণা চুল্লি নির্মাণের কাজ শুরু করে ইরান। তবে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির শর্তের কারণে এই প্রকল্পের কাজ পরে স্থগিত করা হয়।
এদিকে ইরান আইএইএ-কে জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালের মধ্যে চুল্লিটি চালু করার পরিকল্পনা করছে।
এই গবেষণা চুল্লিটি মূলত চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এ ছাড়া সেখানে ‘হেভি ওয়াটার’ উৎপাদনের একটি কেন্দ্রও রয়েছে।
তেহরান
তেহরান পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে একটি চুল্লি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৭ সালে চিকিৎসাবিষয়ক রেডিও আইসোটোপ উৎপাদনের জন্য এটি ইরানকে সরবরাহ করেছিল।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
বুশেহর
দক্ষিণ ইরানের বন্দরনগরী বুশেহরে অবস্থিত দেশটির একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাশিয়া নির্মাণ করেছে। এটি ২০১১ সালে আংশিকভাবে চালু হয় এবং ২০১২ সালে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।
রাশিয়া এখনো এই কেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ করে এবং কেন্দ্রটি আইএইএ-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
প্রথমে একটি জার্মান কোম্পানি এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর এটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে মস্কো এটি সম্পন্ন করে।
দারখোভিন ও সিরিক
২০২২ সালের শেষ দিকে ইরান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় দারখোভিনে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে।
২০২৪ সালের শুরুতে তারা হরমুজ প্রণালির সিরিকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের সম্মিলিত সক্ষমতার চারটি পৃথক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করে।
তথ্যসূত্র: জিও নিউজ
Leave a Reply