কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘ আমরা পিছনকে (অতীত) পিছনে ফেলে দিতে চাই। আমরা প্রতিহিংসার পক্ষে না। এখন জাতি সামনে আগাতে চায়। জাতিকে সামনে আগাতে হলে সীসাঢালা প্রাচীরের ঐক্য লাগবে।’
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে জেলা জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় আমিরের উপস্থিতিতে এই সম্মেলন ছিল জেলায় প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত স্থানে জামায়াতের কর্মী সম্মেলন। হাজারো নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে সকাল ৯ টায় সম্মেলন শুরু হয়ে বেলা ১২ টায় শেষ হয়।
৪০ মিনিটের দীর্ঘ বক্তব্যে জামায়াতের আমির পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমালের পুরো সময় জুড়ে হওয়া বিভিন্ন হত্যাকান্ড এবং জুলুম নিপিড়নের শিকার জনতার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। সকলকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে প্রতিটি হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি জানান।
মক্কা বিজয়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে জামায়াতের আমির বলেন, ‘সেদিন রাসূল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু নিরীহ মানুষকে খুনকারী কিছু খুনির নাম ধরে তাদেরকে খুনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। খুন কখনও মাফ হয় না। আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা খুনের বিচার চাই। শুধু আমাদের নেতৃবৃন্দ না, আমাদের কর্মী না। যত মানুষকে অন্যায়ভাবে খুন করা হয়েছে সবার বিচার চাই।’
এক এগারোর সরকার আওয়ামী লীগ এনেছিল অভিযোগ করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সকল অপকর্মের দায়মুক্তির ওয়াদা করে তারা ক্ষমতায় বসে। ক্ষমতা গ্রহণের পর পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে নারকীয় হত্যাকান্ডের মাধ্যমে হত্যার যাত্রা শরু করে। এরপর ক্ষধার্ত আওয়ামী লীগ জাতীয় সম্পদ চুরি শুরু করলো। সর্বত্র চাঁদাবাজি-লুটপাট। ঘুষের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। তাদের অর্থমন্ত্রী বললো, “ এটা ঘুষ না, স্পিড মানি।” শিক্ষামন্ত্রী বললো, “ আমার মন্ত্রণালয়ে তোমরা ঘুষ খাইয়ো কিন্তু একটু কমাইয়া খাইয়ো।” এরা শিক্ষিত নাকি কু-শিক্ষিত আল্লাহই ভালো জানেন।’
বিএনপি সহ সমসাময়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে জামায়াত আমির বলেন, ‘ এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক সংগঠন জামায়াতের দিকে হাত বাড়ালো। যখন বিপদ আসলো তখন আমাদের রাজনৈতিক বন্ধুদের অনুরোধ করেছিলাম, বিপদের ঢেউ জামায়াত পর্যন্ত থামবে না। এই ঢেউ সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যদি সম্মিলিতভাবে ঠেকাতে না পারি। আমাদের আহাজারি বোঝাতে পারিনি, শোনাতে পারিনি। একের পর এক প্রতিহিংসামূলক রায়ের মাধ্যমে আদালতকে ব্যবহার করে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো।’
বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মানুষের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘ দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিজমকে বিদায় করতে গিয়ে একটা মানুষ শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের ইতিহাসে তার নামটা লেখা হয়ে গেছে। এই সন্তানটাও বৃহত্তর রংপুরের। তার নাম আবু সাঈদ। সে আমাদের বিপ্লবের প্রতীক। আমাদের নেতা, আমাদের সিপাহসালার, আমাদের বীর সেনাপতি। তার রাস্তা ধরে এবার যারাই জীবন দিয়েছে মহান রবের দরবারে দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা সবাইবে শহীদ হিসেবে কবুল করুক।’
কুড়িগ্রামের রৌমারীর বড়াইবাড়ি সীমান্তে বিএসএফর বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর সাহসী প্রতিরোধ ভূমিকার প্রশংসা করে জামায়াত আমির বলেন, ‘যে যুদ্ধটা আপনারা রাতের অন্ধকারে করে শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল বিডিআরের পিলখানা হত্যাকান্ডে। কিন্তু আপনাদের গর্বিত ইতিহাস এখনও চকচক করছে।’
জুলাই অভুত্থানে শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ডা. শফিকুর বলেন, ‘যারা পঙ্গু হয়েছে তাদেরকে আমরা যেন গর্বের সাথে সম্মান করতে পারি, শ্রদ্ধার সাথে বুকে ধারণ করতে পারি। আমরা শহীদেরকে কোনও দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে চাই না। শহীদ এবং পঙ্গু সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই ঋণগুলি শোধ করার শক্তি জাতির নেই। তবে যে কারণে তারা শহীদ হয়েছেন আমরা তাদেরকে কথা দিচ্ছি। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি দুর্নীতিমুক্ত, সুসম, বৈষম্যহীন, মানবিক বাংলাদেশ না গড়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।’
উপস্থিত জনতার উদ্দেশে হাত জোর করে জামায়াত আমির বলেন, ‘ বিনয়ের সাথে সবাইকে বলবো, শহীদদের আকাঙ্খার বাইরে যায় এমন কাজ দয়া করে কেউ করবেন না।’
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার স্লোগান- ‘ আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’ উচ্চারণ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘ হ্যাঁ যুদ্ধ সেদিনই শেষ হবে যেদিন মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। তার আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধ ইনশাআল্লাহ চলবে। আমরা সমাজে অনাচার হলে তার প্রতিবাদ করবো। অনাচার যিনি করবেন তার ব্যাপারে আমরা মুখ বন্ধ করে থাকবো না। আমরা এজন্যই রাজনীতি করি।’
সংখ্যালঘু শব্দ ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে জামায়াত আমির বলেন, ‘ আমরা তেমন করে কাউকে বিবেচনা করতে চাই না। এই দেশ আমাদের সকলের। আমরা সকলে এই দেশের নাগরিক। সংখ্যালঘু শব্দ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেছে।’
অতীতে সবকিছুর জন্য জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছে জানিয়ে আমিরে জামায়াত বলেন, ‘ ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের বর্তমান সময় পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কারা এদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে জুলুম অত্যাচার করেছে, তাদের জমি দখল করেছে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, সম্পদ লুন্ঠন করেছে, তাদের ইজ্জতে হাত দিয়েছে- এই দুস্কৃতিকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে জনগণের সামনে প্রকাশ করা হউক। জনগণ জানুক এরা কারা। খুনি-ধোকাবাজ কে? জনগণ তা জানতে চায়।’
জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা নিজাম উদ্দিনের সঞ্চালনা ও জেলা আমির মাওলানা আব্দুল মতিন ফারুকীর সভাপতিত্বে সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, কর্ম পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল সহ জেলা নেতৃবৃন্দ। পরে জামায়াতের আমির সহ নেতৃবৃন্দ সীমান্ত হত্যাকান্ডের শিকার ফেলানী খাতুনের বাবা-মায়ের সাথে সাক্ষাত করতে নাগেশ্বরীর রামখানা ইউনিয়নে তাদের বাড়িতে যান।
Leave a Reply