মোঃ ফরিদুল ইসলাম:
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষি-কেন্দ্রিক। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত এই কৃষি খাত প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪০% সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত, অথচ এই কৃষি ও কৃষকরা আজও থেকে যাচ্ছে অবহেলিত, বঞ্চিত এবং শোষিত। ফসল ফলানোর পর থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই তারা নানান সমস্যার শিকার।
আজকের এই লেখায় আমরা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির অভাব এবং বীজ সংরক্ষণ থেকে কৃষকদের দূরে রাখার মতো গভীর সংকটগুলো তুলে ধরব।
কৃষকের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। মাঠে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করেও তারা কখনোই তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য পান না।
ধরুন ধানচাষের কথা। একটি বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে সার, বীজ, সেচ এবং কীটনাশকের জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, ফসল বিক্রি করতে গিয়ে দেখা যায়, উৎপাদন খরচ ওঠানোই কঠিন হয়ে পড়ে। এক মণ ধানের বাজারদর ১২০০ টাকা, অথচ উৎপাদন খরচ পড়ে গেছে ১৩০০ টাকা। এই ব্যবধান কৃষকদের দিন দিন আরও দরিদ্র করে তুলছে।
সরকার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে ফসল কম দামে বিক্রি করে দেন, যা শোষণের আরেকটি রূপ।
কৃষকদের শ্রমের মুনাফার বড় অংশ কেড়ে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। এই শোষণ চক্র এতটাই সুসংগঠিত যে, কৃষকের পক্ষে সরাসরি বাজারে তাদের ফসল বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব। মধ্যস্বত্বভোগীরা অল্প দামে কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে শহরের বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে।
একজন কৃষক যখন মাঠ থেকে এক মণ ধান ১২০০ টাকায় বিক্রি করেন, সেই ধান মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত ঘুরে ২০০০ টাকায় শহরের বাজারে পৌঁছায়। ফলে ভোক্তারা বেশি দাম দেন, অথচ কৃষক তার ন্যায্য অংশ পান না।
একসময় কৃষকেরা তাদের নিজের উৎপাদিত বীজ সংরক্ষণ করত। এতে তাদের উৎপাদন খরচ কমত এবং স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে কৃষকদের সেই অধিকার প্রায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভরতা এখন এতটাই বেড়েছে যে, কৃষকেরা আর নিজের বীজ সংরক্ষণ করতে পারে না। প্রতি মৌসুমে নতুন করে বীজ কিনতে হয়, যা কৃষকদের আর্থিক বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া হাইব্রিড বীজের দাম প্রচলিত বীজের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
হাইব্রিড বীজের দাপটে স্থানীয় জাতের বীজ দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই স্থানীয় বীজগুলো ছিল বেশি টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং স্বল্প খরচে ব্যবহারযোগ্য। কৃষকদের এই বীজ নির্ভরতা দূর করতে হলে স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষকদের বেশিরভাগই এখনো প্রথাগত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের উৎপাদনশীলতা কমছে। অধিক ফলনশীল বীজ, আধুনিক সেচ পদ্ধতি, মাটির উর্বরতা পরীক্ষার সরঞ্জাম ইত্যাদির অভাব কৃষকদের পিছিয়ে রাখছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য করলে কৃষকেরা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারত।
বাংলাদেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার কৃষকদের জীবন অনিশ্চিত করে তুলেছে। মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের ক্ষতি হয়। অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে নদীভাঙনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে অনেক কৃষিজমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে, যা কৃষকের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে।
মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে হলে তাদের সরাসরি বাজারে ফসল বিক্রির সুযোগ দিতে হবে। ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস বা সরাসরি কৃষিপণ্যের হাট চালু করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষকরা নিজেদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে জাতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ তারা শোষিত, অবহেলিত, এবং দুর্দশাগ্রস্ত। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করা, স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ, এবং আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো মানে পুরো জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করা। একটি সুস্থ, সবল এবং সুশৃঙ্খল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের জাতীয় উন্নয়নের মূল
Leave a Reply