1. editor1@kurigramsongbad.com : কুড়িগ্রাম সংবাদ :
  2. sifat@kurigramsongbad.com : sifat :
  3. siteaccess@pixelsuggest.com : কুড়িগ্রাম সংবাদ :

খেজুরের গুড়: ঐতিহ্য, স্বাদ, এবং বাস্তবতার গল্প

  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ৪৯২ বার পড়া হয়েছে

শীতকালের সকালে খেজুর গাছের রসের হাঁড়ি থেকে টুপটুপ করে পড়া রসের শব্দ যেন বাংলার এক অনন্য গ্রামীণ চিত্র। আর এই রস যখন গুড়ে রূপান্তরিত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে এক বিস্ময়কর মিষ্টি ঐতিহ্যের প্রতীক। খেজুরের গুড় শুধু একটি খাবার নয়, এটি বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

খেজুরের গুড় উৎপাদন বাংলার একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। শীতকালে, বিশেষ করে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত, খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। এই রস থেকেই তৈরি হয় খেজুরের গুড়, যা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে—ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, দানাগুড় এবং নলেন গুড়। এই গুড়ের স্বাদ, গুণ এবং বৈচিত্র্য তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত থাকে।

বাংলার মানুষের সঙ্গে খেজুরের গুড়ের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর ও অটুট। এই সম্পর্কের প্রমাণ ইতিহাসে সহজেই পাওয়া যায়।

খেজুরের গুড়ের ইতিহাস প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো এবং এটি বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী গ্রাম শিল্প। শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত কাব্যগ্রন্থে নলেন গুড়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের “যশোহর খুলনার ইতিহাস” বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯০০-১৯০১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গে মোট ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে যশোরে তৈরি হয়েছিল ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের ধোবায় প্রথম খেজুর গুড় ও চিনি তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়, যা ছিল অবিভক্ত ভারতে পাম চিনি তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম শিল্পায়ন। পরবর্তীতে, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের তীরে তাহেরপুরে মিস্টার নিউ হাউস খেজুর গুড় ও চিনি উৎপাদনের একটি যান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলেন। সেই কারখানার উৎপাদিত গুড় ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। সময়ের সঙ্গে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠে মোট ১১৭টি কারখানা, যা খেজুর গুড়ের উৎপাদন ও বাণিজ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।

অতীতের ধারাবাহিকতা এখনো ধরে আছে যশোর। খেজুরের গুড়ের কথা বললেই দেশের যেসব অঞ্চলের নাম সবার আগে আসে, তার মধ্যে যশোর ও কুষ্টিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য। যশোর অঞ্চলের একটি প্রবাদ রয়েছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার আটটি উপজেলায় প্রায় আট লাখ খেজুরগাছ রয়েছে, যার মধ্যে যশোর সদর, মনিরামপুর, শার্শা, চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছ রয়েছে। এই জেলার খেজুরগাছ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন গুড় ও পাটালি উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের খেজুর গুড় শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক। খাঁটি খেজুরের গুড়ে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, আয়রন, ভিটামিন B কমপ্লেক্স, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মতো উপকারী উপাদান রয়েছে। এগুলো আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী, বিশেষ করে হাড়ের স্বাস্থ্য এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য। এছাড়া, খেজুরের গুড় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, ত্বককে সুন্দর ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে, এবং এটি হজমের সমস্যা দূর করতে সহায়ক।

তবে, এই ঐতিহ্যের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে, এবং ইটভাটায় গাছ পোড়ানো বা জমির পরিবর্তন এর জন্য দায়ী। এছাড়া খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য দক্ষ কর্মীর অভাবও দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এ কাজ করতে চান না, কারণ এর পারিশ্রমিক খুব কম।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো খেজুরের গুড়ের নকল উৎপাদন। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে নকল গুড় তৈরি করছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খাঁটি গুড় এবং নকল গুড়ের পার্থক্য বোঝা গেলেও সচেতনতার অভাবে অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন।

তবে, বাংলাদেশে খেজুর গুড়ের উৎপাদন ও এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য স্থানীয় উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খেজুর গাছের রস সংগ্রহকারীদের অবস্থার উন্নতি, তাদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি, এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমানো গেলে, এটি গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য, খেজুর গাছ সংরক্ষণ এবং নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া গুড় উৎপাদনের প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণ করতে হবে, যা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী শিল্প সৃষ্টি করতে পারে। খেজুর গাছের চাষ বাড়ানো এবং গুড়ের উৎপাদন উন্নত করার মাধ্যমে, এটি গ্রামীণ অর্থনীতি ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

খেজুরের গুড় আমাদের শেকড়ের মিষ্টি পরিচয়, যা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আসুন, আমরা সবাই মিলে খেজুরের গুড়ের এই মিষ্টি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা টিকিয়ে রাখি। এটি শুধু আমাদের দেশের ঐতিহ্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী বাঙালি সংস্কৃতির এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে বাংলার কৃষি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক শক্তিশালী মেলবন্ধন রচিত হতে পারে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এবং জাতীয় পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।

লেখা: শামিম হোসেন–শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটেগরিতে আরো খবর


Kurigram Songbad © 2025. All Rights Reserved.
Built with care by Pixel Suggest
error: Content is protected !!