লেখা–মোঃ ফরিদুল ইসলাম:
নদীর বুকে জেগে থাকা এক টুকরো স্বপ্নের নাম রাজিবপুর-রৌমারী। ব্রহ্মপুত্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতোই এখানকার মানুষের বুকভরা আশা, কিন্তু সেই আশার তীরে ভিড়তে পারেনি উন্নয়নের পালতোলা নৌকো।
পার্শ্ববর্তী দেওয়ানগঞ্জে রেলগাড়ির হুইসেল বেজে ওঠে প্রতিদিনই, ধোঁয়া উড়ে যায় আকাশে, অথচ এই জনপদে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। চরভরা এই জনপদে কেবলই বয়ে চলে দীর্ঘশ্বাস—’আমাদেরও তো হক আছে স্বপ্ন দেখার, কবে আসবে সেই রেলগাড়ি?’
যুদ্ধ করে পাওয়া স্বাধীনতার দেশ, কিন্তু স্বাধীনতার সুফল ছুঁতে পারেনি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের এই মানুষগুলো। ভাঙন, দুর্যোগ আর অবহেলার ফাঁস কাটিয়ে কবে নতুন সকাল দেখবে তারা? যখন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রেললাইন ছুটে চলছে উন্নয়নের বার্তা নিয়ে, তখন রাজিবপুর-রৌমারীর মাটি কেন আজও সেই বার্তা পায় না? এই জনপদের ধুলো মাখা পথ ধরে তো হাঁটতে পারে উন্নয়নের পদধ্বনি! কিন্তু কে শোনে সেই কান্না, কে শোনে সেই আর্তি?
রাজিবপুর-রৌমারী’র কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী—সবাই অপেক্ষায়। চোখে স্বপ্নের নোনা জল, কানে রেলগাড়ির প্রতীক্ষিত হুইসেলের প্রতিধ্বনি। কবে আসবে সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, কবে ভাঙবে বঞ্চনার এই দীর্ঘ দেয়াল?
রাজিবপুর ও রৌমারী—দুই নদীঘেরা জনপদ। নদী এখানে আশীর্বাদ তো বটেই, অভিশাপও কম নয়। ভাঙনের ভয়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, আর অবহেলার শিকলে বন্দি এখানকার মানুষ। দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ পৌঁছালেও, রাজিবপুর-রৌমারীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। যেন এ জনপদ কোনো মানচিত্রেই নেই! অথচ এই অঞ্চলের মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর স্বপ্ন দেখে চলেছে—রেলগাড়ির ধোঁয়া উঠবে আকাশে, হুইসেলের শব্দ ছড়িয়ে পড়বে চরাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে।
কৃষকরা বুকে বাঁধা রেখেছে না বলা কথাগুলো। মাঠে ফলানো ধান, পাট, শাকসবজি সময়মতো বাজারে তুলতে না পারার যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখেছে তারা। যদি রেললাইন থাকত, তাহলে কৃষিপণ্য পৌঁছে যেত রাজধানীর বাজারে, পেত ন্যায্যমূল্য। তাদের ঘামে ভেজা মাটির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত দেশজুড়ে।
ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন দেখেছে, রৌমারী স্থলবন্দর একদিন হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র। পাথর, বালু, বনজ সম্পদ সহজেই পৌঁছে যেত দেশের নানা প্রান্তে। সীমান্ত বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত খুলত। নদীপথের সীমাবদ্ধতা ভুলিয়ে দিত রেলপথের অবাধ যাত্রা।
পর্যটন খাতেও রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। ব্রহ্মপুত্রের তীর, চরাঞ্চলের অপরূপ সৌন্দর্য, মেঘে ঢাকা সবুজ মাঠ—সবই হতে পারে পর্যটকদের জন্য এক স্বপ্নলোক। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে দেশ-বিদেশের মানুষ ছুটে আসত এই সৌন্দর্যের টানে।
তবু কেন এই অবহেলা? কেন এই অযত্ন? স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এলেও কেন রাজিবপুর-রৌমারীর মানুষ এখনও অবহেলার বোঝা টেনে বেড়ায়?
সরকারের দৃষ্টি কি কখনো পড়বে না এই জনপদের দিকে? উন্নয়নের যে আলো রাজধানী থেকে দূরের প্রান্তিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল, তা কি এখানকার মানুষ কখনো পাবে না?
এখনই সময়। আর নয় অবহেলা, আর নয় প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। রাজিবপুর-রৌমারীর মানুষের স্বপ্ন পূরণে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। রেলপথের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
এই অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী—সবাই একটাই স্বপ্ন দেখছে। রেলগাড়ির হুইসেলে ভাগ্যবদলের সূচনা হবে। উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাবে জীবন।
রাষ্ট্রের কাছে আমাদের জোরালো দাবি—রাজিবপুর-রৌমারী রেলপথের প্রকল্প দ্রুত হাতে নিন। উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করুন এই জনপদকে। এই জনপদে বিশাল সংখ্যক অবহেলিত মানুষ আছে, তাদের কান্না ও স্বপ্নের কথাও শোনা উচিত।
রেলগাড়ির ধোঁয়া যেন ছুঁয়ে যায় রাজিবপুর-রৌমারীর আকাশ। হুইসেলের শব্দ ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি চরাঞ্চলে, প্রতিটি ঘরে। ভাগ্যের চাকা ঘুরুক, বদলে যাক জীবনের গল্প।
রেলপথ আসবেই—এই আশায়, এই প্রত্যাশায়।
Leave a Reply