কুড়িগ্রাম সংবাদ ডেস্ক:
১৪ বছর আগে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে কিশোরী ফেলানির নির্মম মৃত্যু হয়েছিল কুড়িগ্রাম সীমান্তে। কিন্তু এখনো বিচার পায়নি ফেলানির পরিবার, এবং সীমান্তে হত্যার ঘটনাও বন্ধ হয়নি। ফেলানি হত্যার পর থেকেই একের পর এক সীমান্ত হত্যা ঘটছে, এবং এর কোনো প্রতিকার বা সমাধান এখনও দেখা যায়নি।
ফেলানির পরিবারকে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন ১৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল, তবে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতীয় আদালত এই ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে আপিল করে তা আটকে রেখেছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৪ বছরের ফেলানি নিহত হন। তার লাশ দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা কাঁটাতারের সঙ্গে ঝুলে ছিল, যা সারা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি করে। সেই হত্যার ১৩ বছর পর, ২০২৩ সালে আবারও একটি ঘটনা ঘটে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৪ বছরের কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহত হন, যখন তিনি তার মা এবং ভাইকে ভারতের ত্রিপুরায় দেখতে যাচ্ছিলেন।
ফেলানি হত্যার ১৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার শহীদ মিনারে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ একটি গণজমায়েতের আয়োজন করে, যেখানে ফেলানির বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ফেলানির মা জাহানারা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন, “আমি শুধু আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই না, আমি চাই সীমান্তে যেন আর কেউ মারা না যায়, যেন আর কোনো লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে না থাকে। ১৪ বছরেও কিছু কমেনি, প্রতিদিন সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে।”
ফেলানির বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখনও বিচার পাইনি, কিন্তু আশা ছাড়িনি। অনেক চেষ্টা করেছি, ভারতেও গিয়েছি, তবে কেউ কোনো সাহায্য করেনি। তবে আমাদের নতুন সরকারের প্রতি আশা আছে, তারা কিছু করবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কিছু সহায়তা পাইনি, সংসারের টানাপোড়েনে একটি চায়ের দোকান চালিয়ে সাতজনের পরিবারে খরচ চালাতে হয়।” তিনি জানান, “আমরা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেছি, তিনি আমাদের পরিবারে দায়িত্ব নিয়েছেন এবং সব কিছু এখন থেকে দেখবেন।”
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে দাবি জানানো হয়েছে। তবে বাস্তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলি ও হত্যার ঘটনা থামছে না। বিএসএফের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বৈঠকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে— ২০২৪ সালে বিএসএফের হাতে ৩০ জন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে ২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২৩ সালে নিহত ২৮ জনের মধ্যে ২৪ জনকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এই পরিসংখ্যান থেকেই এটা স্পষ্ট যে বিএসএফ সীমান্তে ব্যাপকভাবে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে, যা জীবনহানি ঘটাচ্ছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “বিএসএফের গুলি সরাসরি নিরীহ মানুষদের লক্ষ্য করে, যদিও তারা চোরাচালান রোধের কথা বলে, তবে বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধেই ঘটে। ফেলানি কিংবা স্বর্ণা কোনোভাবেই চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সীমান্তে গরু চোরাচালান হয় না, সেগুলো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আসে। তবে যখন সীমান্তে চোরাচালান নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়, তখন বিএসএফ সেসব মানুষদের গুলি করে হত্যা করে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এবং ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, সীমান্তের মানুষ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িত থাকে, কিন্তু বিএসএফ এসব বিষয় নিয়ে কোনও গুরুত্ব দেয় না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনেক সময়ই নতজানু ছিল, তবে এখন আমরা প্রতিবাদ করতে শুরু করেছি।”
‘অধিকার’ মানবাধিকার সংস্থার পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, “ভারত সীমান্ত হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে মানসিক চাপ তৈরি করতে চায়, যাতে তারা ভয় পায় এবং ভারতের প্রতি নির্ভরশীল থাকে। এতে সীমান্ত হত্যা কমছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে। তারা প্রায়ই নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। সীমান্তে চোরাচালান হতে পারে, তবে চোরাচালান নিয়ে গুলি করে হত্যা করা কি ন্যায্য?”
ফেলানি হত্যার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হলে বিএসএফ তাদের নিজস্ব ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয়। তবে এই বিচার কখনোই তৃপ্তিদায়ক হয়নি। যদিও বিএসএফ হত্যাকারীকে স্বীকার করেছে, তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠনও এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছে, তবে বিচার এখনও প্রক্রিয়াধীন। ভারতের মানবাধিকার কমিশন ১৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিলেও, তা এখনও আটকে রয়েছে।
সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ সাকিব আলী বলেন, “ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। এখন সময় এসেছে এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরার। আমাদের দুর্বলতার কারণেই ভারত এই হত্যাকাণ্ডগুলো করে পার পেয়ে যাচ্ছে।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে এবং নির্যাতনে ৬০৭ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ‘অধিকার’ সংস্থার হিসাবেও ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৫৮২ বাংলাদেশি নিহত ও ৭৬১ জন আহত হয়েছেন। সূত্র: ডয়চে ভেলে
Leave a Reply