সিইও স্যাম অল্টম্যানের নেতৃত্বে ওপেনএআই ‘কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা’ (এজিআই) অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, যা ভবিষ্যতে সাই-ফাই সিনেমার মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ এআই তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যদিও ওপেনএআই ইতোমধ্যেই তাদের জিপিটি-ও৩ মডেল প্রকাশ করেছে, এটি পরবর্তী প্রজন্মের এআই মডেল তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে বলেও জানা গেছে। ২০২৫ সালে কোম্পানিটি এর শীর্ষস্থান ধরে রাখবে বলেই মনে করছেন বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ, যদিও এআই নিরাপত্তা এবং বাজারের প্রভাব নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকবে।
প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে সিরি ও আলেক্সা
২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত অ্যাপলের সিরি ও অ্যামাজনের আলেক্সা এআই-চালিত ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। তবে চ্যাটজিপিটির উত্থানের ফলে এগুলোর সীমাবদ্ধতা তীব্র হয়ে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
অ্যামাজন আলেক্সাকে আধুনিক করার চেষ্টা করলেও, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে এটি তেমন উন্নতি করতে পারেনি। ২০২৫ সালে অ্যালেক্সা আরও দুটো কথা বেশি বলতে পারলেও এটির পক্ষে তার চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয় বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে, অ্যাপল ‘অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স’ নামক একটি নতুন এআই-প্রযুক্তি চালু করেছে। তবে চ্যাটজিপিটির ওপর নির্ভর করে চললেও অ্যাপল গোপনীয়তা ও ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিজের নিয়ন্ত্রণেই রেখেছে।
চাকরির ভবিষ্যৎ ও এআই
এআই কি আমার চাকরি কেড়ে নেবে? — ২০২৪ সালে এ প্রশ্নটি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ‘এজেন্ট’ এআই-এর মতো নিজের কাজ নিজে করতে সক্ষম এআই টুল তৈরির পর এ আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। ফলে নিম্নস্তরের, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলোতে মানুষ-কর্মীর বিপরীতে এআই একটি বাস্তব হুমকি হয়ে উঠেছে।
তবে অনেক প্রযুক্তি কোম্পানি দাবি করছে, এআই কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক হবে। যেমন, গ্রাহক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান অ্যালোরিকা এআই অনুবাদ টুল ব্যবহার করে এটির কর্মীদের ২০০টিরও বেশি ভাষায় কাজ করার সক্ষমতা দিয়েছে। গুগল, আইবিএম ও মাইক্রোসফট-এর মতো বড় কোম্পানিগুলোও মনে করছে, এআই তাদের কর্মীদের জন্য নতুন দক্ষতা তৈরি করবে।
তবে বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এক প্রতিবেদন জানিয়েছে, এআই বৈশ্বিক শ্রমবাজারে ইতোমধ্যেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে এটি কর্মীদের দক্ষতা বাড়ালেও, প্রায় ৪০ শতাংশ চাকরি এআই-এর কারণে পরিবর্তিত বা বিলুপ্ত হতে পারে।
পরে জুন মাসে সিটিব্যাঙ্কের একটি গবেষণায়ও উল্লেখ করা হয়, এআই স্বয়ংক্রিয়তার কারণে আর্থিক খাতের প্রায় অর্ধেক পেশা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে পেপাল-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা, বিলিয়নিয়ার ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা পিটার থিয়েল বলেন, এআই শীঘ্রই অনেক বেশি চাকরির ওপর প্রভাব ফেলবে না, তবে এটি বিশেষ করে গণিত তথা সংখ্যাতত্ত্ব-নির্ভর পেশাগুলোতে সর্বাগ্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২৪ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে শুরু হওয়া এসব বিতর্ক আগামী বছর আরও তীব্র হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এআই-এর সমর্থক ও সমালোচক উভয়পক্ষই তাদের যুক্তি আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করবেন।
এআই-প্রযুক্তি ও বিতর্কিত ঘটনা
২০২৪ সালে এআই প্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। জালিয়াতি, অপব্যবহার, এবং ভুল তথ্য ছড়ানোর ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত বৈশ্বিক নির্বাচনের এ বছরটিতে এসব ঘটনা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন, একটি অডিও ডিপফেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্য বলে প্রচারিত হয়, যা নির্বাচনের আগে নিউ হ্যাম্পশায়ারের ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
গতবছর এআই প্রযুক্তির অপব্যবহারের আরেকটি বড় উদাহরণ হলো হংকংয়ের একটি কোম্পানির ২৫ মিলিয়ন ডলারের এআই-ভিত্তিক প্রতারণার শিকার হওয়া।
এছাড়া, মাইক্রোসফটের কোপাইলট এবং গুগলের জেমিনি মডেলের মতো এআই প্রযুক্তির অস্বাভাবিক ও নেতিবাচক আচরণও সামনে এসেছে। যেমন, জেমিনি কর্তৃক একজন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়ার ঘটনার কথাও জানা গেছে। যদিও এগুলো ঘটনা বিচ্ছিন্ন, তবে এসব ঘটনাও এআই-এর নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
এআই প্রযুক্তি মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগেও সমালোচনার মুখে পড়ে ২০২৪ সালে। গুগল এবং অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলো অনুমতি ছাড়া মানবসৃষ্ট কন্টেন্ট ব্যবহার করে এআই-কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে সৃজনশীল শিল্পের পেশাদাররা ভবিষ্যতে তাদের পেশা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
এআই নিয়ন্ত্রণ
এআই প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে ২০২৪ সালে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনাও ক্রমশ তীব্র হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এআই ব্যবহারে নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী আইনের প্রস্তাব দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এআই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে, তবে এটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আগস্ট মাসে এক জরিপে ৯৯ শতাংশ মানুষ এআই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তবে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর হবে না।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
২০২৪ সালে চ্যাটবট, ভয়েস ক্লোনিং, ইমেজ জেনারেশন, এবং মিউজিক তৈরির মতো ক্ষেত্রগুলোতে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে ‘এজেন্ট’ এআই এবং ‘রিজনিং’ মডেলগুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ মডেলগুলো ধাপে ধাপে কাজ সমাধান করতে পারবে এবং ব্যবহারকারীদের আরও নির্ভরযোগ্য সহকারী হিসেবে গড়ে উঠবে।
২০২৫ সালে এআই শিল্পের নেতৃত্বে থাকবে ওপেনএআই, গুগল, মাইক্রোসফট এবং অ্যাপল-এর মতো কোম্পানি। পাশাপাশি, ইলন মাস্কের গ্রোক-এর মতো নতুন উদ্যোগগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে শিল্পটি এত দ্রুত পরিবর্তনশীল যে, কোনো স্টার্টআপও আকস্মিকভাবে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকবে, এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
Leave a Reply