ধর্ম ডেস্ক:
প্রকৃত মুমিন কখনও গায়ের জোর ও পান্ডিত্যকে সফলতার সিঁড়ি মনে করেন না। বরং আল্লাহ তাআলার দয়ার ভিখারি হয়ে নিজের শক্তি-সামর্থ্যকে তাঁরই পথে পরিচালিত করেন এবং যেকোনো বিষয়ে তাঁরই সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করেন।
এই প্রতীক্ষার ফল বড়ই মধুর। প্রিয়নবী (স.) সব বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনি ধৈর্যধারণ করুন আপনার রবের সিদ্ধান্তের উপর; নিশ্চয় আপনি আমার দৃষ্টিতেই রয়েছেন। যখন আপনি দণ্ডায়মান হন, তখন আপনার রবের সপ্ৰশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।’ (সুরা তুর: ৪৮)
উল্লেখিত আয়াতে ‘আমার দৃষ্টিতেই রয়েছে ‘ বলতে আল্লাহর দৃষ্টি আপনার হেফাজতে আছে বুঝানো হয়েছে। তার মানে, সবরকম অনিষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষা করা হবে। এটি মহান আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত। এই নেয়ামতের জন্য যেকোনো বিষয়ে মুমিনকে মহান আল্লাহর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আল্লাহ তাআলার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণায় আত্মনিয়োগ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, যা মানবজীবনের আসল লক্ষ্য এবং প্রত্যেক বিপদ থেকে বেঁচে থাকার প্রতিকারও।
বান্দা জানে না কোথায় তার কল্যাণ। সে বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে ভারী মনে করো, অথচ তোমাদের জন্য তা-ই কল্যাণকর। আবার এটাও হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে পছন্দ কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা অকল্যাণকর। আর (প্রকৃত বিষয় তো) আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’ (সুরা বাকারা: ২১৬)
আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণে নিজেরই ক্ষতি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তোমার যে কল্যাণ হয়, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। আর যে অকল্যাণ হয়, তা তোমার নিজের আমলের কারণে হয়।’ (সুরা নিসা: ৭৯)
অর্থাৎ আল্লাহ সবসময় বান্দার মঙ্গল করেন। কিন্তু বান্দা ভুলক্রমে বা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেই নিজের ক্ষতি করে থাকে। আল্লাহ তাতে বাধা দেন না বান্দার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিকে অব্যাহত রাখার জন্য। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহ) বলেন- ‘সাহায্য, নিরাপত্তা ও রিজিকের যে নেয়ামত তুমি পেয়ে থাক, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ। আর অপমান, লাঞ্ছনা, ভীতি ও অসুস্থতাসহ যেসব বিপদের সম্মুাখীন তুমি হয়ে থাক, তা তোমার পাপ ও গুনাহের কারণে হয়ে থাকে। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ ফাতাওয়া, ৮ খণ্ড, পৃ-২৩৯)
মুমিনের জন্য জরুরি যে, সব বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত, হুকুম, ফায়সালা মেনে নেওয়া এবং তাতে সন্তোষ প্রকাশ করা। এটাই হলো আনুগত্য। আর আনুগত্য পূর্ণতা লাভ করে আল্লাহ বিপদের মাধ্যমে পরীক্ষা নিলে ধৈর্য ধারণ, অনুগ্রহ করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, তাঁর নির্ধারিত ভাগ্য, ফায়সালা, দান ও ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতি সন্তোষ প্রকাশের মাধ্যমে। মুমিন সর্বাবস্থায় ইসলামের আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে এবং রীতিনীতি, শিষ্টাচার, আদর্শ, নৈতিকতা, জীবনযাপন, দুনিয়াবিমুখতা ও পরকালীন কল্যাণ লাভে সচেষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যথাযথ আনুগত্য করবে।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ: ৬/২৪৯১)
তাছাড়া আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করা ধৈর্যের পরিচায়ক। ধৈর্য এমন একটি নেয়ামত, যা সবাইকে দেওয়া হয়নি। এর পুরস্কার অবর্ণনীয়। এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে। (সুরা জুমার: ১০) অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘মহান আল্লাহ ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন।’ (সুরা বাকারা: ১৫৩)
নবী-রাসুল ও সাহাবিদের একটি মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা যেমন আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন, তেমনি তাঁদের প্রতিও মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট।’ (সুরা তাওবা: ১০০)
পবিত্র কোরআনে ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সে তার পরিবার-পরিজনকে নামাজ ও জাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তার প্রতিপালকের সন্তোষভাজন।’ (সুরা মরিয়ম: ৫৫)
আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার নানাবিধ পুরস্কার কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুরা ফাজর: ২৭-৩০)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে এবং মুহাম্মদকে নবী হিসেবে খুশি মনে মেনে নিয়েছে, তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে গেছে।’ (সহিহ মুসলিম: ১৮৮৪)
আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট ব্যক্তির মুখমণ্ডল পরকালে উজ্জ্বল হবে এবং তারা পার্থিব জীবনের মতো পরকালে থাকবে পরিতৃপ্ত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে আনন্দোজ্জ্বল। নিজেদের কর্ম-সাফল্যে পরিতৃপ্ত।’ (সুরা গাশিয়া: ৮-৯)
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে আল্লাহ ইহকালে ও পরকালে তাদের জন্য যথেষ্ট হবে। আল্লাহ বলেন, ‘ভালো হতো যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তাদের যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট হতো এবং বলত, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, আল্লাহ আমাদের দেবেন নিজ করুণায় এবং অচিরেই তাঁর রাসুলও; আমরা আল্লাহর প্রতি অনুরক্ত।’ (সুরা তাওবা: ৫৯)
আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও দ্বীনের ব্যাপারে সন্তুষ্ট না থাকলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন ফেরেশতারা তাদের মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে তাদের প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের দশা কেমন হবে! এটা এ জন্য যে তারা তা অনুসরণ করে, যাতে আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তার সন্তুষ্টিকে অপ্রিয় গণ্য করে; তিনি তাদের কাজ নিষ্ফল করে দেন।’ (সুরা মুহাম্মদ: ২৭-২৮)
Leave a Reply