অনলাইন ডেস্ক:
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচী ঘোষণা সরকারের মেয়াদ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার সমাপ্তি ঘটিয়েছে। ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। এরকম হলে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে দুই বছরেরও কম।
মেয়াদের দিক থেকে, ৮ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর শপথ নেওয়া ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার, ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর দ্বিতীয় স্থানে থাকবে।
গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন ঘোষণা করা হবে না বলে শুরু থেকেই অনড় ছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যৌক্তিক সংস্কারের সময় হাতে রেখে নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল।
অনেক রাজনৈতিক দলের মতে, অধিকাংশ সংস্কার জনগণের নির্বাচিত সরকার দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মেয়াদের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ক্ষমতার পালাবদল একটি নিয়মিত ঘটনা।
এসব সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।
প্রথমবারের মতো
এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি সরকার প্রথম গঠিত হয় ১৯৯০-৯১ সালে, যখন সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশ শাসন করছিলেন।
১৯৯০ সালে বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং ৫টি বাম দল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
এরশাদ এরপর প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেন। ত্রিদলীয় জোট তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করে।
এরশাদের পদত্যাগের পর শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং দেশের প্রথম উপদেষ্টা সরকার গঠন করেন।
সংবিধানের স্বীকৃতি
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচনে তিন দলের মতবিরোধ থেকেই এই অস্থিরতা তৈরি হয়। এর জেরে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন ও হরতাল।
এরপর ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করে।
১৯৯৫ সালের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়।
তার নেতৃত্বাধীন সরকার জুন ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করে। নির্বাচনের পর ক্ষমতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মেয়াদ ছিল প্রায় তিন মাস।
আইনের বিধানে
আওয়ামী লীগের মেয়াদ শেষে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যকর করা হয়।
২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদ শেষ হলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তার নেতৃত্বে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে।
বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রায় চার মাস দায়িত্ব পালন করেন।
আরেক সংকট, নতুন পরিস্থিতি
২০০৬ সাল নাগাদ আগের নির্বাচনের শান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে।
বিচারপতি কে এম হাসান পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধিতার মুখে তিনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান।
এরপর বিএনপির পরামর্শে ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সংবিধান অনুযায়ী, বিকল্প না থাকলে রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ ছিল।
তবে বিরোধী দল এই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি।
দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসেরও কিছু বেশি সময় পর, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ
শেখ হাসিনার দাবির পর ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পরিবর্তন আনা হয়। এরপর সামরিক সমর্থিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ।
এই সরকার তাদের ৯০ দিনের নির্ধারিত মেয়াদের অনেক বেশি সময় ধরে, জানুয়ারি ২০০৭ থেকে জানুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল।
এই সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ ও নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তারা সফলভাবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে, যেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে।
শেষ কি?
২০০৮ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করে, হয়। যদিও পরবর্তী দুই নির্বাচনের জন্য এটি ব্যবহার করার অনুমতি ছিল।
পরবর্তী তিনটি জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যা নির্বাচনগুলোর সুষ্ঠুতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছে। তবে ১৩ বছর পর ফের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরবে কি না, তা নির্ধারণ হতে পারে আজকের হাইকোর্টের রায়ে।
Leave a Reply