আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মিকুয়েল ইচারি; এল পাইস
চীনের চংকিং শহর আর দশটা নগরীর চেয়ে বেশ আলাদা। আধুনিক এ নগর হয়ে উঠেছে প্রবাসী, ভ্রমণপিপাসু ও ইনফ্লুয়েন্সারদের আকর্ষণের কেন্দ্র।
চংকিংয়ের অন্যতম আকর্ষণ হলো বিশাল পান্ডাদের জন্য বিখ্যাত চিড়িয়াখানা, ২২-তলা ভবনের ছাদে নির্মিত একটি পাবলিক স্কয়ার—এবং একটি উড়াল রেলপথ। এ রেলপথের প্রধান একটি স্টেশন অবস্থিত এক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের ভেতরে। দেখে মনে হয়, এই ঝুলন্ত সেতুগুলো ভবিষ্যৎ থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। ইয়াংজি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জাঁকজমকপূর্ণ, বহুবর্ণ আকাশরেখা দেখাও এক বিরল অভিজ্ঞতা। এছাড়াও চিংকংয়ে রয়েছে একটি অ্যাকুয়াটিক মিউজিয়াম।
মিডিয়া আউটলেটগুলো চিংকংকে ‘ব্লেড রানার’-এর শহরের জীবন্ত অবতার বা ‘চীনের সাইবারপাঙ্ক রাজধানী’ হিসেবে বর্ণনা করে। একে বলা যায়, এ গ্রহের ‘সবচেয়ে অবিশ্বাস্য’ শহরও।
ইউটিউবার ও পর্যটক সের্গি ওয়ালিভারের মতে, চংকিং অনন্য গত কয়েক বছরে তার দ্রুত ও অপ্রস্তুত উন্নয়নের কারণে। ছিল। স্পষ্ট কোনো নিয়মকানুন ছাড়াই বিকশিত হওয়া এ নগরী পরিণত হয়েছে ‘ডিস্টোপিয়ান’ শহরে।
‘বীরের নগরী’
চংকিংকে ভালোমতো বুঝতে হলে একনজরে এর ইতিহাসের ওপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। চীনের প্রাণকেন্দ্রের কাছেই অবস্থিত চংকিং। একসময় এ শহরের দখল নিয়ে দক্ষিণ ও উত্তর চীনা রাজবংশের মধ্যে ছিল রেষারেষি। এ নগরী একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথের ট্রানজিট পয়েন্ট, কিন্তু সিল্ক রুট থেকে দূরে হওয়ায় প্রথম শ্রেণির বাণিজ্যিক কেন্দ্র হতে পারেনি।
হাজার বছর চংকিং ছিল বণিক ও জেলেদের নিস্তরঙ্গ নগরী। ২০ শতকের শুরুর দিকে শহরটি বৈশ্বিক ভূরাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। পশ্চিমা শক্তিগুলো যখন বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ইয়াংজি নদীর রুট উন্মুক্ত করে দিতে চীনকে চাপ দেয়, তখনই এই রূপান্তর ঘটে। ১৯০১ সালে চংকিংয়ে জাপানিদের বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমেই নগরটি আধুনিকতার দিকে এগোতে শুরু করে।
১৯৩৮ সালে উত্তর চীনে জাপানি আগ্রাসনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই-শেক চংকিংকে চীনের রাজধানী করেন। সে সময় শহরটি সিচুয়ান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন এ নগরের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ।
যুদ্ধের সময় ‘বীরের নগরী’ নামে পরিচিত চংকিং তীব্র বোমা হামলার শিকার হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা। পরবর্তী সময়ে শহরটির ব্যাপক পুনর্গঠন প্রয়োজন হয়।
১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর চংকিংকে শিল্প ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অচিরেই দক্ষিণ-পশ্চিম চীনসহ দেশে অন্যান্য অঞ্চল দলে দলে মানুষ এসে বসতি স্থাপন শুরু করে চংকিংয়ে।
নদীর তীরে গোলকধাঁধা
চংকিং এখন বেইজিং, সাংহাই ও তিয়ানজিনসহ চীনের চারটি বৃহৎ নগরসমষ্টির একটি। এই অঞ্চলগুলো কোনো প্রদেশের অংশ নয়—সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়।
চংকিংয়ের মহানগর এলাকাটি অস্ট্রিয়ার চেয়ে সামান্য বড়। এ মহানগরে রয়েছে ২৬টি জেলা ও ১২টি কাউন্টি। এখানকার জনসংখ্যা ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি।
বিশাল আকার ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে শহরটি দক্ষিণ চীনের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। এ নগরের কাছেই অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থ্রি গর্জেস ড্যাম। ১৯৯৭ সালে নির্মিত এই প্রকল্পে প্রায় এক বিলিয়ন ঘনফুট কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। এর নির্মাণ ব্যয় ৫০ থেকে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ড্যাম আধুনিক চীনের উন্নয়নের অন্যতম মাইলফলক এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
চংকিং শহর গড়ে উঠেছে এর পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। ড্যাম নির্মাণের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ গ্রাম ও বসতবাড়ি হারিয়েছে। উদ্বাস্তু এসব মানুষ নতুন করে এই শহরে জীবিকা খুঁজে পেয়েছে।
চংকিংয়ের অনেক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের পেছনে সরকারি ব্যাখ্যা হলো, এর ভৌগোলিক অবস্থান। এই ভৌগোলিক অবস্থান নগর পরিকল্পনার পেছনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে শহরের বাসিন্দারা নতুন ও ভিন্নভাবে নির্মাণ এবং ধারাবাহিকভাবে সৃজনশীল চিন্তা করে। এর ফলাফল হিসেবে আর্কিটেকচারাল ডাইজেস্ট-এর সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে চংকিংকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে একটি ‘ত্রিমাত্রিক, বহু-স্তরবিশিষ্ট গোলকধাঁধা’ হিসেবে।
ইউটিউবার ও স্থানীয় বাসিন্দা জ্যাকসন লু-র ভাষায়, শহরটি দুটি বৃহৎ নদী ইয়াংজি ও জিয়ালিংয়ের তীরে একটি অনিয়মিত পাহাড়ি মালভূমিতে অবস্থিত। এর অর্থ হলো, এখানে সমতল ভূমি খুব কম। তাই এখানে ‘ভার্টিকাল স্পেস’, অর্থাৎ উপরের দিকে জায়গার সদ্ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক, যেমনটা করা হয়েছে হংকংয়ে। শহরটির সম্প্রসারণ করতে হলে উপরের দিকেই করতে হবে। মাঝে মাঝে আশপাশের পাহাড়ের ধালে অথবা পাহাড় কেটে সেখানে শহরটির সম্প্রসারণ করা হয়।
আকাশচত্বর
চংকিংয়ে গগনচুম্বী ভবনের ছড়াছড়ি। ৩০ তলার বেশি উঁচু আবাসিক ভবন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া জাগানো আবিষ্কার ‘স্কাই স্কয়ার’ বা ‘আকাশচত্বর’ —সবই চমকপ্রদ। জ্যাকসন লু টিকটকের একটি ভাইরাল ভিডিওতে—ইতিমধ্যে যার ভিউ ৩০ মিলিয়ন পেরিয়েছে—এমনই একটি জায়গা দেখিয়েছেন।
কুইক্সিংলৌ স্কয়ার এক বিশাল এলাকা। নদীবন্দরের পাশেই এক অফিস কমপ্লেক্সের ২২ তলায় অবস্থিত। কল্পনা করুন, আপনি একটি বড় শহরের কোনো প্লাজায় হাঁটছেন। প্লাজার একপ্রান্তে গিয়ে রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট, যা নদীর ২০০ ফুট ওপরে অবস্থিত। সংক্ষেপে এ-ই হলো কুইক্সিংলৌ স্কয়ার।
ভিডিওতে লু তার ‘পাগলাটে শহরের’ দৈনন্দিন জীবন তুলে ধরেন। দেখান, কীভাবে তিনি তার অ্যাপার্টমেন্ট (যা দেখতে অনেকটা গুহার মতো) থেকে বেরিয়ে মেট্রো স্টেশনে প্রবেশ করেন। মেট্রো স্টেশনটিকে দেখতে লাগে পরমাণু হামলা পর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে বাঁচার জন্য তৈরি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রবেশপথের মতো।
সেখান থেকে ওয়াকওয়ে এবং করিডোরের একটি ঘন নেটওয়ার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে যান। তারপর বাসে চড়েন। বাসটি একটি উঁচু বৃত্তাকার রিং রোডে চলে।
লু এমন একটি ব্রিজ অতিক্রম করেন, যেমনটা টিম বার্টনের সিনেমায় দেখা যায়। মাটির ৩০০ ফুট নিচে অবস্থিত একটি মেট্রো স্টেশনে নামেন। সেখানে যেতে টোল দিয়ে এসকেলেটর ব্যবহার করতে হয়।
বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায় ট্রেন
লেখিকা অলিভিয়া হিথ চংকিংয়ের বিস্ময়কর ট্রেনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মুগ্ধতা লুকানোর চেষ্টা খুব একটা করেন না। এই ট্রেন চলে একটি ১৯ তলা ভবনের ভেতর দিয়ে। এ ফ্ল্যাট ব্লকের ছয় থেকে আটতলাজুড়ে অবস্থিত লিজিবা স্টেশন। এতে ভবনের বাসিন্দাদের জন্য দারুণ সুবিধা হয়েছে। তারা সরাসরি চংকিং রেল ট্রানজিট নাম্বার ২-এ উঠে পড়তে পারেন।
অলিভিয়ার মতে, ৩১ হাজার বর্গমাইল জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা ৪৯ মিলিয়ন মানুষের প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত সৃজনশীল সমাধান এটি।
এরকম একটা প্রকৃত হোম-ডেলিভারি গণপরিবহন সেবা যে ২০০৪ সাল থেকে বলতে গেলে কোনো অভিযোগ বা বড় ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া চলছে, তাতেই মুগ্ধ অলিভিয়া। তিনি বলেন, ‘শব্দ কমানোও বাসিন্দাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। ট্রেনের ছুটে যাওয়ার শব্দের মাত্রা প্রায় ৬০ ডেসিবেল। অর্থাৎ ডিশওয়াশারের চেয়ে বেশি শব্দ হয় না এতে।’
গত কয়েক মাসে সাইবারপাঙ্ক ধাঁচে গড়ে ওঠা চংকিং অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে। তবে ওয়ান্ডারপ্লেটের মতো সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, এর বাইরেও চংকিংয়ের আরেকটা চেহারা আছে। হোংইয়া কেইভ কমপ্লেক্সে ঘুরতে যাওয়ার পরামর্শ দেয় সংবাদমাধ্যমগুলো। সেখানে জিয়ালিং নদীর বাঁকে স্তম্ভের ওপর নির্মিত মনোমুগ্ধকর নদীতীরবর্তী ভবন রয়েছে অনেকগুলো। মূল কাঠামোগুলো—যা একসময়ের চংকিংয়ের নিরিবিলি নদীবন্দরের সাক্ষী—কয়েক দশক ধ্বংসস্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ২০০৫ সালে ওই কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়। ২০০৬ সাল থেকে এখানে মূল শহরের নকশার আদলে ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলোর একটি নতুন কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। এই জায়গাকে হায়াও মিয়াজাকির চলচ্চিত্রের একটি আদর্শ সেটিং মনে হতে পারে। এই কমপ্লেক্সে ঘুরতে গেলে এর জনপ্রিয় বাজার এবং চারতলার একটি চমৎকার রেস্তোরাঁয় ঢুঁ না মারলেই নয়। ওই রেস্তোরাঁয় পরিবেশন করা হয় বিখ্যাত স্থানীয় চাটনি ‘সালা মালা’। এই চাটনি এতটাই ঝাল যে মুখ অসাড় হয়ে আসে।
প্রাচীন এই শহরের শেষ অংশ সিকিকু -কে থিম পার্কে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এটিও দেখার মতো জায়গা। এছাড়া ইয়াংজি নদীর গভীর তলদেশে অবস্থিত আধুনিক স্থাপনার বাইহেলিয়াং আন্ডারওয়াটার মিউজিয়ামও দর্শনীয়। ভবিষ্যতের এই নগরীর আরেক বড় আকর্ষণ স্থানীয় চিড়িয়াখানার বিষণ্ণ পান্ডারা। প্রাণীগুলোর সময় কাটে লতাপাতা চিবিয়ে, উদাস চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে।
Leave a Reply