লেখক–মোঃ ফরিদুল ইসলাম, তরুন লেখকঃ কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল যেন এক অনন্ত সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। এখানে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও তা সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। ব্রহ্মপুত্রের ভয়াল গর্জন প্রতি বছর নতুন করে সৃষ্টি করে শূন্যতা, যা পূরণ করতে হয় মানুষের সীমাহীন লড়াই দিয়ে। নদীর ভাঙন শুধু ভিটেমাটি কেড়ে নেয় না; কেড়ে নেয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি জীবনের মৌলিক অধিকার। তবুও চরবাসীর জীবন থেমে থাকে না। প্রতিবার বিপর্যয়ের পর তারা আবারও উঠে দাঁড়ায়, খড়কুটো দিয়ে গড়ে তোলে নতুন ঠিকানা।
এক জনপদের হারানো ও নবজাগরণের গল্পঃ মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ভেলামারী, একসময় যা ছিল তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিকানা। নদীর ভাঙনে আজ সেই জনপদ শুধুই স্মৃতির অংশ। তবু এই জনপদ আবার জেগে উঠেছে ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম পাড়ে। গড়ে উঠেছে বসতি, প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাজার। বর্তমানে কয়েকশো পরিবারের বাস এই নতুন চরে। নতুনভাবে জীবন শুরু করলেও এখানকার মানুষগুলো এখনও বঞ্চিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে।
একটি সময় এই জনপদ শিক্ষার আলোয় আলোকিত ছিল। আজ এখানকার শিশুরা বিদ্যালয়ের অভাবে শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। একইভাবে, একটি ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসার জন্যও চরবাসীকে পাড়ি দিতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। নৌকাভাড়া এবং সময়ের ব্যয় সামলানো তাদের জন্য প্রতিনিয়ত একটি চ্যালেঞ্জ।
প্রতিদিনের লড়াই ও চরাঞ্চলের বাস্তবতাঃ ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী এই চরাঞ্চল প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে। বর্ষার বন্যা, শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন নিস্তব্ধতা, এবং নদীভাঙনের তাণ্ডব এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। পুরুষেরা কৃষিকাজ বা গবাদি পশু পালনে ব্যস্ত থাকলেও নারীরা গৃহস্থালির পাশাপাশি সংসারের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং মৌলিক সেবার অভাব অত্যন্ত প্রকট। শিশুদের পুষ্টিহীনতা, নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া, এবং বারবার ভাঙনের ফলে জীবনের প্রতি জন্ম নেওয়া হতাশা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
সম্ভাবনার হাতছানিঃ চরাঞ্চলগুলো শুধু সমস্যারই কেন্দ্র নয়; এখানে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। উর্বর মাটির কারণে কৃষিতে বিপুল উৎপাদন সম্ভব। ভুট্টা, গম, সবজি চাষে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে। এছাড়া গবাদি পশু পালন, মৎস্য চাষ, এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করার মাধ্যমে চরের অর্থনীতিকে জাতীয় উন্নয়নের অংশীদার করা সম্ভব।
একটি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে চরবাসীর জীবনমান উন্নত করা সম্ভব। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ, এবং চর রক্ষায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ এখানে পরিবর্তন আনতে পারে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও নাগরিক প্রত্যাশাঃ চরের মানুষের এই লড়াই শুধু তাদের একার নয়। এটি আমাদের সবার লড়াই। রাষ্ট্রের উচিত এই জনপদের মানুষের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে চরাঞ্চলকে এক সম্ভাবনাময় অঞ্চলে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
ভেলামারীর মতো জনপদ শুধু ভাঙনের গল্প নয়; এটি জীবনের গল্প, যা বারবার হারিয়ে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র যদি তাদের পাশে দাঁড়ায়, তবে একদিন এই চরাঞ্চল দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে জায়গা করে নেবে।
Leave a Reply