ধর্ম ডেস্ক:
আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। কিন্তু অনেকে ইবাদত তো দূরের কথা, সত্য উপলব্ধি করতেও অক্ষম। তাদের অন্তর আছে, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারে না। চোখ আছে কিন্তু সত্য দেখতে পায় না। এসব লোকেরা কখনও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান আনার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে না। ফলে জাহান্নামে যাওয়াটাই তাদের জন্য বাকি থাকে।
তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- وَ لَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۫ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ ‘আর অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষকে। তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বুঝে না; তাদের রয়েছে চোখ, তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের রয়েছে কান, তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট।’ (সুরা আরাফ: ১৭৯)
এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে, আমি বিনা কারণে তাদেরকে জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছিলাম। বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, আমি তো তাদেরকে হৃদয়, মস্তিষ্ক, কান, চোখ সবকিছু দিয়ে সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু তারা এগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেনি এবং নিজেদের অসৎ কাজের কারণে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের জাহান্নাম দেওয়া আল্লাহর ইনসাফের চাহিদা। সে হিসেবে তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন যে, তারা জাহান্নামে যাবে, সুতরাং তাদেরকে যেন তিনি জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেওয়ার জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
বাস্তবে এরা পাগল বা উম্মাদ নয় যে, কিছুই বোঝে না, অন্ধ নয় যে কিছু দেখে না এবং বধির নয় যে কিছু শুনেও না। প্রকৃতপক্ষে এরা পার্থিব বিষয়ে অধিকাংশ লোকের তুলনায় অধিক সতর্ক ও চতুর। এরপরও তাদের যা করা উচিত ছিল, তারা তা করেনি। যা কিছু বুঝেছে, দেখেছে এবং শুনেছে, সবই ছিল সাধারণ জীবজন্তুর পর্যায়ের তথা গাধা-ঘোড়া, গরু-ছাগলের সমান।
এজন্যই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে- “এরা চতুষ্পদ জীব-জানোয়ারের মতো।” এরপর বলা হয়েছে- “এরা চতুষ্পদ জীব-জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট”। এর কারণ হলো- চতুষ্পদ জীব-জন্তু শরিয়তের বিধি-নিষেধের আওতাভুক্ত নয়; তাদের জন্য কোনো সাজা-শাস্তি নেই। কিন্তু মানুষকে তার কাজের হিসাব দিতে হবে। তার কৃতকর্মের ওপর নির্ভর করবে প্রতিদান বা শাস্তি। কাজেই আল্লাহর আদেশ-নিষেধের প্রতি গাফেল থাকা জীবজন্তুর চেয়েও অধিক নির্বুদ্ধিতা। তাছাড়া জীব-জন্তু নিজের প্রভু ও মালিকের সেবা করে। পক্ষান্তরে অকৃতজ্ঞ না-ফরমান মানুষ নামের জন্তুরা স্বীয় মালিক, পালনকর্তার নাফরমানি করে। তাই তারা চতুষ্পদ জানোয়ার অপেক্ষা বেশী নির্বোধ ও গাফেল। (দেখুন, ফাতহুল কাদির; তাফসিরে তাবারি; ইবনে কাসির)
আয়াতের সরল অনুবাদ দেখলে মনে হবে যেন তাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। বস্তুত কোরআনের অনন্য ভাষাশৈলী, বর্ণনার নৈপুণ্য ও ভাবের গাম্ভীর্য এমনই। সুরা বাকারার ৬ ও ৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন- اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا سَوَآءٌ عَلَیۡهِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَهُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ وَ عَلٰی سَمۡعِهِمۡ ؕ وَ عَلٰۤی اَبۡصَارِهِمۡ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ‘নিশ্চয় যারা কুফরি করেছে, তুমি তাদেরকে সতর্ক করো বা না করো, সবই তাদের জন্য সমান, তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা। আর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক আজাব।’
এ দুটি আয়াতে নবীজিকে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে যে, তিনি যেন কাফেরদের জন্য বেশি দুঃখ না করেন এবং ঈমানের পথে আনার জন্য ব্যস্ত না হয়ে পড়েন। তাদের ঈমান না আনার দায় তাঁর নয়।
কাফেরদের অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে মানে তাদের অন্তর সত্য গ্রহণ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। কানে মোহর মারা ও চোখে পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়ার মানে হলো- তাদের সামনে কোরআন পড়া হলে তারা বোঝে না। আল্লাহর সৃষ্টি দেখেও তার পরিচয় ও ক্ষমতা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। তাই তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকা হলেও তারা ঈমান আনে না। এটা তাদের নিজেদের অবাধ্যতা। কোরআন কিংবা নবীজি (স.) বা অন্যকারো ত্রুটি নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের কুফরির কারণে সত্য থেকে বঞ্চিত। তারা নিজেদের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সত্য উপলব্ধি করেনি এবং সে অনুযায়ী কাজও করেনি।
আয়াতে ‘আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন’ বলে বোঝানো হয়েছে, এটা আল্লাহর নীতি যে বারবার সত্য প্রত্যাখ্যান করলে অন্তর সত্যগ্রহণে অক্ষম হয়ে যায়। এরকম নয় যে তারা কুফুরি করতে বাধ্য বা আল্লাহ তাদেরকে ঈমান থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। বরং অনবরত কুফরির প্রভাবে তাদের অন্তর কুফরির দ্বারা বশীভূত ও একাকার হয়ে গেছে এবং অন্যকিছু গ্রহণ করার যোগ্যতাই আর তার মধ্যে নেই। তাদেরকে শাস্তি থেকে বের করা আল্লাহর কর্তব্য নয়। তিনি তাদেরকে তাদের কোনো হক থেকে বঞ্চিত করেননি। বরং তিনি তাদের অবাধ্যতার কারণে শুধু অনুগ্রহ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন- وَ قَالُوۡا قُلُوۡبُنَا غُلۡفٌ ؕ بَلۡ لَّعَنَهُمُ اللّٰهُ بِکُفۡرِهِمۡ فَقَلِیۡلًا مَّا یُؤۡمِنُوۡنَ ‘আর তারা বলল, আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; বরং তাদের কুফরির কারণে আল্লাহ তাদেরকে লানত করেছেন। তারপর তারা খুব কমই ঈমান আনে।’ (সুরা বাকারা: ৮৮)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন- فَاَعۡرَضَ اَکۡثَرُهُمۡ فَهُمۡ لَا یَسۡمَعُوۡنَ وَ قَالُوۡا قُلُوۡبُنَا فِیۡۤ اَکِنَّۃٍ مِّمَّا تَدۡعُوۡنَاۤ اِلَیۡهِ وَ فِیۡۤ اٰذَانِنَا وَقۡرٌ وَّ مِنۡۢ بَیۡنِنَا وَ بَیۡنِکَ حِجَابٌ ‘তারপর তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, অতএব তারা শুনবে না। তারা বলে, ‘তুমি আমাদেরকে যে দিকে আহবান করছ সে বিষয়ে আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত, আমাদের কানের মধ্যে রয়েছে বধিরতা আর তোমার ও আমাদের মধ্যে রয়েছে অন্তরায়।’ (সুরা ফুসসিলাত: ৪-৫)
বস্তুত কাফেররা তাদের অহমিকা ও অবাধ্যতার পরও আল্লাহর কর্তৃত্ব থেকে বের হতে পারে না। তারপরও অনেক মানুষ ঈমানের পরিবর্তে কুফরকে বেছে নেয়। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আল্লাহর শাস্তি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ তাআলার শাস্তিকে ভয় করার তাওফিক দান করুন। চোখে সত্য দেখার অন্তরে সত্যকে উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply