আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান
মাত্র তিন দিনে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোর দখল নিয়েছে বিদ্রোহীরা। বিস্ময়করভাবে পতন হয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত সরকারি বাহিনীর। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাজধানী দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন।
আজ রোববার (৮ ডিসেম্বর) সকালে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে এমনটাই জানিয়েছেন দেশটির সেনাবাহিনীর দুই সিনিয়র কর্মকর্তা। তবে দামেস্ক ছাড়লেও তিনি কোথায় গেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। বর্তমানে এই গোষ্ঠী সিরিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত।
আল-জোলানির খ্যাতি ক্রমশ বাড়তে থাকায় সেটি কমানোর লক্ষ্যে সোমবার (২ ডিসেম্বর) অনলাইনে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে এবং দাবি করা হয়, তিনি রুশ বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। তবে দ্রুতই প্রমাণিত হয়, ছবিটি ভুয়া এবং তার নিহত হওয়ার খবরটি মিথ্যা।
বর্তমানে তিনি আলেপ্পোতে তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার পাশাপাশি সিরিয়ার আরও অঞ্চল দখলের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
বর্তমান
এইচটিএসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আল-জোলানি প্রায় এক দশক ধরে নিজেকে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে সিরিয়ায় একটি “ইসলামিক প্রজাতন্ত্র” গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেছেন।
২০১৬ সাল থেকে তিনি এবং তার গোষ্ঠী নিজেদের সিরিয়ার স্বাধীন অঞ্চলের বিশ্বস্ত রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় একটি জনপ্রিয় বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন, যার পরিণতি হিসেবে যুদ্ধ চলতে থাকে।
এইচটিএস ২০১৭ সালে সিরীয় স্যালভেশন গভার্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে, যা ইডলিব প্রদেশে প্রশাসন পরিচালনা করে। এই সরকার স্থানীয় সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিচারব্যবস্থা এবং অবকাঠামো সরবরাহের পাশাপাশি অর্থনীতি এবং সাহায্য বিতরণও নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে, এইচটিএস তার শাসনকে কঠোরভাবে পরিচালনা করে এবং বিরোধিতা সহ্য করে না বলে জানান গোষ্ঠীর সক্রিয় কর্মীরা। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন থেকেও এই তথ্য পাওয়া যায়।
স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান সিরিয়া ডাইরেক্ট জানায়, রাজনৈতিক কর্মীদের গুম করার পেছনে এইচটিএস-এর হাত রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে এই গোষ্ঠী। অভিযোগ রয়েছে, এই গোষ্ঠী তাদের বিরোধী সম্প্রদায়গুলোকে বিভিন্ন সেবা সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করেছে।
বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের এই বিদ্রোহী অভিযানে মূল মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জোলানি। পুরো অভিযানেই তার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জোলানির মূল কৌশল ছিল বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদেরকে একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা। তার কৌশল ও নেতৃত্ব বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছে এবং আসাদের অনুগত বাহিনীর পতন ত্বরান্বিত করেছে।
বিদ্রোহীরা প্রথমে আলেপ্পো এবং পরে হামা শহরের দখল নেয়। এরপর ১২ দিনের মধ্যেই তারা রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করে এবং আসাদের শাসনের অবসান ঘটায়।
অতীত
আল-জোলানি ১৯৮২ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে আহমদ হুসেন আল-শারার নামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রিয়াদে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে এবং দামেস্কের কাছাকাছি বসবাস শুরু করে।
২০০৩ সালে তিনি ইরাক চলে যান এবং আল-কায়েদা (ইরাক) সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। সংগঠনটি ওই বছরের আমেরিকার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২০০৬ সালে তাকে ইরাকে আমেরিকান বাহিনী আটক করে এবং পাঁচ বছর বন্দী রেখে পরবর্তীতে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার কাজ দেয়। এই গোষ্ঠী সিরিয়ার বিরোধী অঞ্চলে বিশেষত ইডলিবে প্রভাব বিস্তার করে।
আল-জোলানি প্রথমদিকে আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, যিনি আল-কায়েদার “ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক” এর প্রধান ছিলেন। এটি পরে আইএসআইএল (আইএসআইএল) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে আল-বাগদাদি হঠাৎ করে ঘোষণা দেন, তার গোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং সিরিয়ায় বিস্তার লাভ করবে। ফলে, আল-নুসরা ফ্রন্টকে আইএসআইএসে একীভূত করে নেওয়া হয়। আল-জোলানি এই পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করেন এবং আল-কায়েদার প্রতি তার আনুগত্য বজায় রাখেন।
২০১৪ সালে তার প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আল-জোলানি আল জাজিরাকে বলেন, সিরিয়াকে তার গোষ্ঠীর “ইসলামিক আইন” অনুযায়ী শাসন করা উচিত এবং দেশটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যেমন, খ্রিষ্টান এবং আলাওয়িরা সেখানে স্থান পাবে না।
পরবর্তী বছরগুলোতে আল-জোলানি আল-কায়েদার বৈশ্বিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রকল্প থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। তখন সিরিয়ার ভেতরে নিজেদের শক্তিশালী করাই তার গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য হিসেবে বলে মনে হতে থাকে।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে আসাদ সরকারের কাছে আলেপ্পোর পতন হলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইডলিবে চলে যেতে শুরু করে। তখন আল-জোলানি ঘোষণা দেন, তার গোষ্ঠীর নাম পরিবর্তন করে ‘জাবহাত ফাতেহ আল-শাম’ রাখা হয়েছে।
২০১৭ সালের শুরুতে, হাজার হাজার যোদ্ধা আলেপ্পো থেকে পালিয়ে ইডলিবে প্রবেশ করার পর আল-জোলানি তার গোষ্ঠীকে আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একীভূত করে এইচটিএস গঠন করেন।
এইচটিএস এর প্রধান লক্ষ্য, সিরিয়াকে স্বৈরশাসক সরকার থেকে মুক্ত করা, “ইরানি মিলিশিয়াদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া” এবং “ইসলামিক আইন” অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
ভবিষ্যৎ
যখন বিদ্রোহী যোদ্ধারা আলেপ্পো পুনরুদ্ধার করে দক্ষিণে এগিয়ে যায়, তখন আল-জোলানি সিরিয়ার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর প্রতি আরও সহনশীল মনোভাব দেখান।
আলেপ্পো দখল করার পর তার গোষ্ঠী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী বিষয়ক সিরীয় বিশেষজ্ঞ হাসান হাসান বলেন, আল-জোলানি এইচটিএস গোষ্ঠীকে সিরিয়ায় একটি বিশ্বস্ত শাসন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য অংশীদার হতে চান।
সিএসআইএস এর তথ্য অনুযায়ী, ইডলিবে তিনি হারাকাত নূর আল-দিন আল-জিঙ্কি, লিবা আল-হক এবং জাইশ আল-সুন্নাহ-এর মতো অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি, হুরাস আল-দ্বীন-এর মতো [সিরিয়ায় আল-কায়েদার নতুন শাখা] পুরোনো মিত্রদের এড়িয়ে চলছেন।
বর্তমানে এইচটিএস-কে জাতিসংঘ, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন “সন্ত্রাসী” সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আল-জোলানি দাবি করেছেন, এটি অনুচিত কারণ তার গোষ্ঠী (তার) পূর্ববর্তী আনুগত্যের পরিবর্তে একটি জাতীয় আনুগত্য গ্রহণ করেছে।
তবে, সিরিয়ায় বৃহত্তম বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে আল-জোলানির প্রভাব দেশজুড়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনুভূত হবে।
Leave a Reply