ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
গত দশ বছরে কিবোর্ড এবং স্ক্রীন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্কুল থেকে অফিস পর্যন্ত হাতের লেখার জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিশ্বের কিছু স্কুলে বাচ্চাদের এখন টানা হাতের লেখা শেখানোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তবুও গবেষণা বলছে, কাগজে কোনো কিছু হাতে লেখার কিছু মানসিক সুবিধা আছে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি এ সুবিধা কখনোই দিতে পারে না।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ভাষাবিজ্ঞানের ইমেরিটাস অধ্যাপক নাওমি সুসান ব্যারন বলেন, “হাতে লেখা এবং স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণা [যার মধ্যে জাপান, নরওয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাও রয়েছে] থেকে দেখা যায়, মানুষ কম্পিউটারে কোনো কিছু লিখে মনে রাখার তুলনায় হাতে লিখে আরও ভালোভাবে কোনো কিছু মনে রাখতে পারে।”
ভালো স্মৃতি ধরে রাখা থেকে শুরু উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার ফলাফল পর্যন্ত হাতে লেখার চর্চা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা তথ্য কীভাবে শিখি এবং মনে রাখি, তা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
হাতে লেখার সুবিধা
হাতে লেখার অনেক উপকারিতা রয়েছে, যেগুলো প্রধানত লেখার প্রক্রিয়ায় একাধিক অনুভূতির উপস্থিতির কারণে।
ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি লন্ডনের অকুপেশনাল থেরাপির পাঠক বলেছেন মেলিসা প্রুনটি [হাতের লেখা এবং শেখার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছে] বলেন, “কলম ধরতে, কাগজে চাপ দিতে এবং হাতের সাহায্যে অক্ষর ও শব্দ তৈরি করতে অনেক মনোযোগের প্রয়োজন হয়, যা একটি জটিল দক্ষতা। এই জটিল প্রক্রিয়া শব্দকে অক্ষরের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি শিশুদের পড়তে এবং বানানে সাহায্য করে।”
বয়স্করাও হাতে লেখার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে উপকার পায়। আরবি শিখছে এরকম ৪২ জন বয়স্ক অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, টাইপিং বা শুধু দেখে যারা অক্ষর শিখেছেন তাদের তুলনায় যারা হাতে লিখে অক্ষর শিখেছিলেন, তারা দ্রুত অক্ষরগুলো শনাক্ত পারছিলেন, নাম বলার ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা হচ্ছিল এবং নতুন শেখা অক্ষরগুলো উচ্চারণ করার সময়েও তারা ভালো করেছেন।
ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলাইনা গ্রিনসবোরোর মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার সহলেখক রবার্ট ওয়াইলি বলেন, “আমরা বিশ্বাস কর, হাতের লেখা কীভাবে একই ধারণার জন্য বিভিন্ন পথকে কীভাবে সক্রিয় করে তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের ফলাফলগুলোর একটি অংশের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ।”
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, একটি নতুন শব্দ শেখার জন্য একটি এবস্ট্রাক্ট (বিমূর্ত) চিহ্নকে ভিজ্যুয়াল, মোটর এবং শ্রবণ স্তরের তথ্যের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়। রবার্ট বলেন, “হাতের লেখা টাইপিংয়ের তুলনায় এই বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে আরও সংযোগ তৈরি করতে পারে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ২০৫ জন তরুণের ওপর চালানো জরিপের মাধ্যমে অধ্যাপক নাওমি সুসান ব্যারন আবিষ্কার করেছেন, অনেক শিক্ষার্থী হাত দিয়ে লেখার সময় বেশি মনোযোগী থাকে এবং তাদের স্মৃতিশক্তিও ভালো থাকে, যা টাইপ করার তুলনায় বেশি কার্যকর। এটি নির্দেশ করে, আমরা যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করি তার জন্য আমাদের স্পর্শের অনুভূতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের অনুভূতিগুলি সক্রিয় করা আমাদের শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে, যদিও এটি অবাক করার মতো মনে হতে পারে। স্পর্শ এবং গতির মতো কর্মকাণ্ড শেখা এবং স্মরণের সাথে জড়িত মস্তিষ্কের একই অংশকে সক্রিয় করে, বলেন সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেন অ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক লিসা আজিজ-জাদেহ। তিনি ব্যাখ্যা করেন, মানব মস্তিষ্ক বিকাশ লাভ করেছে স্পর্শ এবং মোটর তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য এবং মস্তিষ্কের এই অংশগুলো এখন উচ্চ স্তরের চিন্তাভাবনাতেও ব্যবহৃত হয়।
টাইপিংয়ের তুলনায় হাতে লেখার সুবিধা
নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির নিউরোসাইকোলজির অধ্যাপক অড্রে ভ্যান ডার মেয়ার বলেন, “আমাদের অনুভূতিগুলো কীভাবে আমাদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে, তা বুঝতে আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে একটি রাস্তা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।” তিনি বলেন, শিশুদের মস্তিষ্কের নেটওয়ার্কগুলো দুর্বল এবং জঙ্গলের প্যাঁচানো পথের মতো। অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই পথগুলো হাইওয়ে হয়ে ওঠে এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে দ্রুত এবং কার্যকরীভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ভ্যান ডার মেয়ার এবং তার সহলেখক রুুদ ভ্যান ডার উইল লেখার কাজ করা ৩৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মস্তিষ্কের স্ক্যান পরীক্ষা করেন । শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল পেন ব্যবহার করে টাচস্ক্রিনে ‘পিকশনারি’ শব্দ লিখেছিলেন অথবা কিবোর্ডে টাইপ করেছিলেন। গবেষকরা প্রতিটি কাজের সময় অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ধারণ করতে ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাম (ইইজি) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন।
গবেষক ভ্যান ডার মেয়ার বলেন, “সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, হাত দিয়ে লেখার সময় পুরো মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। কিন্তু টাইপ করার সময় মস্তিষ্কের ছোট ছোট কিছু অংশ কাজ করে। এর মানে, হাত দিয়ে লেখার সময় মস্তিষ্কের বেশি অংশ কাজ করে।”
এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, হাত দিয়ে লেখার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, যা শেখার জন্য উপকারী। ভ্যান ডার মেয়ার বলেন, “গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের আলফা ও থেটা তরঙ্গ শেখা ও মনে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, হাত দিয়ে লেখার সময় এই তরঙ্গগুলো সক্রিয় থাকে। কিন্তু টাইপ করার সময় তা থাকে না।”
গবেষকরা হাতের লেখার দক্ষতা ধরে রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন। নরওয়ের অনেক স্কুলে এখন আর হাতে লেখা শেখানো হয় না। শিক্ষার্থীরা আইপ্যাডে লিখতে ও পড়তে শেখে। কিন্তু ভ্যান ডার মেয়ার তার গবেষণার মাধ্যমে এই প্রবণতা পরিবর্তন করতে চান।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তত কিছুটা হাতে লেখার অনুশীলন থাকা উচিত। কারণ এটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অত্যন্ত উপকারী।”
যুক্তরাষ্ট্রেও হাতের লেখা পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখার প্রতি এর উপকারিতা দেখে কিছু রাজ্য আবার এটি স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বয়স্কদের জন্যও ভ্যান ডার মেয়ার কলম ও কাগজ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “হাতে লেখার অনুশীলন মস্তিষ্কের জন্য খুব ভালো অনুশীলন। এটি ব্যস্ত সড়কে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার মতো।”
Leave a Reply