আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
যখন একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়, তখন মিসাইলের সঠিক গতিপথ চিহ্নিত করে এটিকে ধ্বংস করতে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে মাত্র কয়েক মিনিট সময় থাকে। গাড়ির আকারের সমান একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল, শব্দের সমান গতিতে ওয়ারহেড নিয়ে মহাকাশের কিনারা ধরে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছুটে যায়।
এপ্রিলে এবং অক্টোবরে, ইরান ইসরায়েলের দিকে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে মোতায়েন করা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছু ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে সক্ষম হলেও সবগুলোকে ঠেকাতে পারেনি। হামলাতে বড় কোনো ক্ষতি না হলেও, ইসরায়েলি এবং আমেরিকান কর্মকর্তার মতে, ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়নি।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণ চালানোর পর, ইরানি কর্মকর্তারা আরেকটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন, যদিও তাদের পরিকল্পনা এখনও অস্পষ্ট।
ইরানের নিক্ষেপ করা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নিক্ষেপের পর তা বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তরে প্রবেশ করে। এরপর আবার পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় শব্দের বেগের সমান গতি নিয়ে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগোতে থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলে পৌঁছাতে প্রায় ১২ মিনিট সময় নেয়। সেজন্য ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় খুব কম থাকে।
ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণের পরপরই শত্রুর স্যাটেলাইটগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে এর হিট সিগনেচার (রকেটের থ্রাস্টারের তাপের রেশ) শনাক্ত করতে হয়। রাডারগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র খুঁজে বের করে এর সঠিক গতিপথ নির্ধারণ করতে হয়। এরপর, একটি প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইন্টারসেপ্টর নামে পরিচিত, দ্রুত উৎক্ষেপণ করতে হয় যাতে এটি আসন্ন ক্ষেপণাস্ত্রটিকে সময়ের মধ্যে ধ্বংস করতে পারে।
একটি একক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যই ব্যাপারটা অনেক কঠিন হলেও, গত মাসে ইরান একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল—প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এক ঘণ্টারও কম সময়ে। লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করা।
একটি রাডার একসঙ্গে মাত্র কয়েকটি লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত ও মোকাবিলা করতে সক্ষম, এবং রকেট লঞ্চারগুলো একবার খালি হলে, তা পুনরায় লোড করতে আধা ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লাগে।
অক্টোবরে ইরানের দ্বিতীয় আক্রমণের পর, ইসরায়েল বলেছে যে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেকগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে, এবং যেগুলো আঘাত হেনেছে সেগুলোর ক্ষতির পরিমাণ খুবই সীমিত।
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, স্যাটেলাইটের চিত্র অনুযায়ী এই আক্রমণে আরও উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, যা ইসরায়েলের নেভাতিম বিমানঘাঁটিরও বেশ ক্ষতিসাধন করেছে। যদি এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো জনবহুল এলাকায় পড়ত, তাহলে প্রাণহানি এবং ধ্বংসের মাত্রা আরও ব্যাপক হতে পারত।
ইসরায়েলের সবচেয়ে পরিচিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো আয়রন ডোম। স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার রকেট ঠেকাতে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়। তবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য আয়রন ডোম খুব একটা কার্যকর নয়। এজন্য, ইসরায়েল আয়রন ডোম বাদে বিভিন্ন পাল্লার অন্যান্য উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে, যা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে তাদের উড্ডয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে মোকাবিলা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
ইসরায়েলের সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো অ্যারো-৩ সিস্টেম, যেটির ইন্টারসেপ্টর বা প্রতিরোধকারী মিসাইল শত্রুর বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রকে বহুদূরে থাকতেই ধ্বংস করতে সক্ষম। ইরানের ছোঁড়া বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সাধারণত অ্যারো-৩ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমই ব্যবহার করে ইসরায়েল।
বায়ুমণ্ডলের অতি উচ্চতায় ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। ইন্টারসেপ্টর এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল উভয়ই তাদের জ্বালানি বুস্টারগুলো ব্যবহারের পর মহাকাশেই ফেলে দেয়। তখন শুধু ইন্টারসেপ্টর ও মিসাইলের বাকি অংশগুলো একে অপরের দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে আসে।
ইন্টারসেপ্টরটি শত্রু মিসাইলের ওয়ারহেড লক্ষ্য করে সরাসরি আঘাত হানে। লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর জন্য, এটি বিশেষ সেন্সর ব্যবহার করে শত্রু ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবিধি ট্র্যাক করে এবং তার দিকে যেতে থ্রাস্টার ব্যবহার করে।
কিন্তু যখন ইন্টারসেপ্টর এক মাইল দূরে তার লক্ষ্যকে শনাক্ত করে, তখন সামঞ্জস্য করার জন্য খুবই কম সময় হাতে থাকে।
এর কারণ হলো, ইরানের ছোঁড়া নতুন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মহাকাশে পৌঁছানোর পর এর আকার মাত্র তিন ফুট চওড়া হয় এবং এগুলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় দুই মাইলের গতিতে ছুটে চলে।
এছাড়া, কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ডেকয় প্রযুক্তিও ব্যবহার করে, যা ইন্টারসেপ্টরকে ধোঁকা দেয়ার সক্ষমতা রাখে।
এছাড়া, বুস্টারের ধ্বংসাবশেষকেও অনেক সময় ইন্টারসেপ্টর, মূল মিসাইল ভেবে ভুল করে থাকে। তবে মহাকাশে ইন্টারসেপ্টরগুলোর কার্যকারিতা কতটা, তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো ঠিক কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র আটকানো পারে, তা সাধারণত কোনো সরকারি সংস্থাই নির্দিষ্ট করে জানাতে চায় না। তারা সফলতা কিংবা ব্যর্থতা যাই হোক, ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করে। একইভাবে, এই ব্যয়বহুল সিস্টেমগুলো তৈরির কোম্পানিগুলোও অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে তাদের ডিফেন্স সিস্টেমের কার্যকারিতার কথা তুলে ধরে
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেমগুলোর সমন্বয়ে, বর্তমানে ইসরায়েল বিশ্বের সর্বাধিক স্তরের স্তরের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করে।
যদি বহিঃস্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভূমির কাছাকাছি নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে আটকাতে অন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। তবে এর জন্য হাতে সময় খুব কম থাকে। একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যের যত কাছাকাছি আসে, ততই এটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এবং যদি কম উচ্চতায় ইন্টারসেপশন সফলও হয়, তাও ধ্বংসের মাত্রা বেশি হওয়ার সভাবনা থাকে।
Leave a Reply